ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

‘মেয়র কাকু’ নতুন প্রজন্মের মানবিক আদর্শ

প্রকাশিত: ২১:৩২, ২৬ জুলাই ২০২০

‘মেয়র কাকু’ নতুন প্রজন্মের মানবিক আদর্শ

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে এ দেশের তরুণ সমাজের মনোজগতে তিনি এমন এক আসনে আসীন হয়েছিলেন যা এই পঞ্চাশ বছর পরে আলোচনা করলেও বিস্মিত হতে হয়। আমরা যারা সদ্য কিশোর, যাদের যুদ্ধে যাবার মতো বয়স বা পরিবেশ হয়েছিল না তাদের কাছে তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর মানুষ। আমাদের অগ্রজ যারা যুদ্ধে গেছেন বা দেশে থেকে যুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছে অনুপ্রেরণার একমাত্র আদর্শ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পাশে থেকে কাজ করেছেন ও দেশ স্বাধীনের সংগ্রাম চূড়ান্ত করেছেন তাদের পরিপাশে ছিল বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার রাজনৈতিক আদর্শ। নদীমাতৃক দেশের শিল্পী তখন গান গেয়েছেন, ‘মুজিব বাইয়া যাওরে...’! দেশে দেশে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে দেশের সব পর্যায়ের ও বয়সের জনমানুষকে একটি মাত্র লক্ষ্যে ধাবিত ও চালিত করার এমন নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত বিরল। এই সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত আসে ১৯৭২ সালে যখন দেশের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে একটি ভিন্ন ও অবাস্তব সমাজতান্ত্রিক আদর্শে নিয়ে যাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা শুরু হয়। অথচ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মূলমন্ত্রই ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শে একটি ন্যায়ানুগ, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন যার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালেই। সে সংগ্রাম দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় ২৩ বছর পরে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করে। কিন্তু একটি ক্ষুদ্র অপশক্তি বরাবরই সে সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেসব ষড়যন্ত্রের অনেক কিছু প্রকাশ্য হয় ও সে সবেরই অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী একদল তরুণকে বিভ্রান্ত করে দলচ্যুত তৎপরতায় নিয়োজিত করা হয়। ইতিহাসে এই বিচ্যুতির আজ যদিও ঠাঁই হয়েছে ভাগাড়ে, কিন্তু সম্মিলিত উদ্যোগে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার দ্বিতীয় সংগ্রামে বাধা পেয়ে বঙ্গবন্ধুর মনোজগতে যে কষ্ট হয়েছিল তা এ দেশের মানুষের মন থেকে আজও মুছে যায়নি। আমার কখনও কখনও মনে হয় দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের আগে ওইসব বিভ্রান্তদের জাতির পিতার আত্মার কাছে ক্ষমা চাওয়ানো উচিত ছিল। ১৯৭৫ সালের আগে ও পরে যেসব অগণিত তরুণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে চেতনায় ধারণ করে সারাদেশের ‘তৃণমূলে’ রাজনীতির ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখতে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে বর্তমানে খুলনার সিটি মেয়র ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা তালুকদার আবদুল খালেক অন্যতম। এরকম হাজারো তালুকদার খালেক বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এঁরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ধারণ করে কখনও কোন হঠকারী রাজনীতির সঙ্গে আপোস করেননি, যে কারণে বঙ্গবন্ধু কন্যার পক্ষে দেশের রাজনীতিতে শত সহস্র অনুসারী কাছে পেয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সঙ্কল্পে দৃঢ় থাকা সম্ভব হয়েছে। সে কথা শেখ হাসিনা নিজেই বলেন, ‘আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মী, সমর্থকরা জীবন দিয়ে সকল প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দলকে টিকিয়ে রেখেছে, শক্তিশালী করেছে’ (আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২২ জুন, ২০২০ তারিখে দেয়া বাণী)। তরুণ তালুকদার আবদুল খালেক স্বাধীনতাউত্তরকালে রামপাল-মোংলা অঞ্চলের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহযোগী বাবু কুবের চন্দ্র বিশ্বাসের অনুসারী ছিলেন। রামপালের গিলাতলা স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক কুবের বিশ্বাস (জন্ম-১৯০৪) ছিলেন সে অঞ্চলে ১৯২৭ সালের ইংরেজীতে গ্র্যাজুয়েট যিনি ’৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদে ও ’৭৩ সালে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন ও বড়’দা বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষানুরাগী ও ত্যাগী এই নেতার সংস্পর্শে এসে খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের মধ্যে এক ব্যাপক জাগরণের সৃষ্টি হয়। গোপালগঞ্জের প্রতিবেশী জেলা (তৎকালীন মহকুমা) হিসেবে বাগেরহাটের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর। টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারের সঙ্গে রামপালের বহু পরিবারের আত্মীয়তা গড়ে উঠে ও সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধু নিজেও এই অঞ্চলে যাতায়ত করতেন। তাঁর প্রায় সমবয়সী বন্ধু বাগেরহাটের শেখ আবদুল আজিজকে সভাপতি করেই তিনি খুলনা আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটি গঠন করেন। বাগেরহাট মহকুমার রামপাল-মোংলা যাতায়াতের জন্য একসময় খুবই দুর্গম বলে পরিচিত ছিল। নদীপথ ছাড়া আর কোন বাহন ছিল না। এই অঞ্চলে এসব সড়ক-মহাসড়ক বা রাস্তার বয়স খুব বেশিদিনের নয়। খুলনা-বাগেরহাট-পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের বাহন ছিল নৌকা বা ছোট আকারের ‘পটপটি’ নামে পরিচিত লঞ্চ। খুলনা থেকে বাগেরহাটের ১৮ মাইল পথ আসা-যাওয়া হতো ব্রিটিশ আমলে চালু রেলপথে। খুলনা শহরের অদূরে রূপসা নদীর পূর্ব পাড়ে একটি রেলওয়ে স্টেশন ছিল যার নাম ছিল ‘রূপসা ইস্ট’। এই পথে খেয়া নদী পার হয়ে মানুষ ট্রেনেই সাধারণত যাতায়াত করত। ঢাকা থেকে তখন রামপাল- মোংলা হয়ে খুলনা যাতায়তের নির্ভরযোগ্য বাহন ছিল নৌ পথের ‘রকেট’ স্টিমার সার্ভিস যা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। নাব্যের কারণে রকেট সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে রূপসা-বাগেরহাট ট্রেন সার্ভিসও বন্ধ করে দেয়া হয়। খুলনা থেকে বাগেরহাট হয়ে প্রচুর মানুষ পিরোজপুর ও বরিশালে যাতায়ত করতো। এই পথের পুরো দক্ষিণ জুড়ে ছোট বড় অসংখ্য খাল ও ছোট নদী প্রবহমান ছিল যে পথে মানুষ ছোট লঞ্চ ও নৌকায় যাতায়াত করত। এরকম এক দুর্গম নদী অঞ্চলের সহজপ্রাণ জনগণ কুবের বিশ্বাসের মতো আস্থাশীল ও হৃদয়বান মানুষের নেতৃত্ব পেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া বাংলাদেশের একটি বড় গণহত্যা সংঘটিত হয় রামপালের ডাকরা গ্রামে যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘ডাকরা গণহত্যা’ নামে পরিচিত। পাকিস্তানী বাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ মে সেখানে ভারতে যাবার জন্য সমাগত প্রায় ছয় শতাধিক মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছিল। এই ঘটনা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশ গঠনে তরুণ সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্তির শিকারে পড়লেও কুবের বিশ্বাস ও সে অঞ্চলের বিখ্যাত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সক্রিয় তৎপরতায় রামপাল– মোংলা অনেকাংশেই বিভ্রান্তিমুক্ত থাকতে পেরেছিল। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল ওহাব, গাজী জলিল ও শেখ জলিলের নাম আজও মানুষের মুখে মুখে। এদেরই সুসংগঠিত মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পরিবেশে তালুকদার খালেকের মতো নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। ১৯৮০ সালে কুবের বিশ্বাসের তিরোধানের পর ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগের আসন পুনরুদ্ধার করেন ও ১৯৯৬ সালে তার দল ক্ষমতায় এলে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তালুকদার খালেক যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন সঙ্গত কারণেই তিনি তাদের কাছ থেকে বন্ধুসুলভ সম্বোধন পেয়েছেন ও পেয়ে থাকেন। এর পরের বর্তমান প্রজন্ম তাকে সম্বোধন করেন ‘ভাই’ হিসেবে। তাদের পরের প্রজন্ম তাকে সম্বোধন করেন ‘কাকু’ হিসেবে। আমার জানা মতে, কোন কর্মী তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন না। দলীয় প্রধানের নির্দেশে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে বর্তমানে খালেক তালুকদার খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে রামপাল-মোংলার বর্তমান প্রজন্ম তাকে ‘মেয়র কাকু’ হিসেবে সম্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু যে তৃণমূলের রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনীতি ও আদর্শ। শহর নির্মাণ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ক্রমবিকাশের একটি কৃত্রিম পর্যায় মাত্র কিন্তু নদীবিধৌত গ্রাম-বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের জন্য যে রাজনীতি তার ধারাবাহিকতাই এদেশের মানুষ দেখতে চায় ও ভালবাসে। এ দেশের মানুষ তাদের জীবন সংগ্রামের পাশে চায় তাদেরই যারা তাদের জীবনেরই অংশ। নেতৃত্ব চায় তাদেরই যারা বঙ্গবন্ধুর মতো বিপদে আপদে ঘরের মানুষের মতো এসে উপস্থিত হয়। যারা মনোযোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়বেন তারা প্রমাণ পাবেন ‘মুজিবুর’ কেমন করে ‘মুজিব ভাই’ ও ‘মুজিব চাচা’ হয়ে উঠলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেও যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উঠা-বসা করতেন তাদের ‘চাচা-চাচি’ বলে সম্বোধন করেন। দলের কর্মীরা নির্দ্বিধায় তাঁকে ‘আপা’ বলেই ডাকেন যেন তিনি তাদের বাড়ির বোন। এটাই বাঙালিত্ব, বাংলাদেশের মানুষ এইটুকু ভালবাসা দিয়ে ও নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়। তালুকদার আবদুল খালেক এক জীবনে তিন প্রজন্মের সঙ্গী হয়েছেন এটা কম পাওয়া নয়। নিঃসন্দেহে রামপাল-মোংলা ও খুলনার মানুষ তাঁকে ভালবাসে। তার দৃঢ়চেতা স্বভাবের জন্য তাঁকে অনেকে ভয়ও পান কারণ গর্জে ওঠা স্বভাবের জন্য তিনি সুবিদিত। কিন্তু অপত্য স্নেহে তিনি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি ও উন্নয়ন একীভূত করেছেন বলেই হয়তো এই প্রজন্ম তার সম্মানের মাত্রাকে স্পর্শ করতে পারছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায় তাতে মানুষের পাশে থাকার যে নেতৃত্বগুণ তা একদিন কাগুজে হবে বা হয়ে যাবে ইতিহাস। তাতে আমরা আমাদের জাতির পিতা ও তাঁর কন্যার গুণ থেকে শিক্ষা না নেয়া জাতিতে পারিণত হব। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষ তা হতে দেবে না। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×