ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উজান থেকে পানি আসা অব্যাহত ॥ বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি নেই

প্রকাশিত: ২২:০৫, ২৫ জুলাই ২০২০

উজান থেকে পানি আসা অব্যাহত ॥ বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একটানা পানিবন্দী হয়ে পড়ায় বানভাসিদের দুঃখের যেন অন্ত নেই। কবে নিজ বাড়ি ঘরে ফিরতে পারবেন তাও জানে না কেউ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে উজান থেকে পানি আসা অব্যাহত থাকায় এখনি দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এ মাস জুড়ে এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। এমনকি এই সময়ের মধ্যে কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তবে ৩০ জুলাইয়ের পর দেশের আপার মেঘনা এবং যমুনা বেসিনে বন্যার উন্নতি হতে পারে। কিন্তু পদ্মা বেসিনের পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। ইতোমধ্যে উজান থেকে বন্যার পানি নেমে আসার কারণে গঙ্গা পদ্মা বেসিনের পানি নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে এর অববাহিকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে ক্রমেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। দেশের মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে বিলিন হয়ে যাচ্ছে এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল। ফলে এসব জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও অন্য জেলার সড়ক ও নৌ যোগাযোগ ব্যাহত হয়ে পড়ছে। এদিকে বন্যার স্থায়িত্ব আজ এক মাস পূর্ণ হচ্ছে। একমাস পানিবন্দী থেকে উত্তরাঞ্চলের মানুষের এখন মাথায় হাত। খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট যেমন দিন দিন প্রকট হচ্ছে। পড়েছেন গৃহপালিত পশুপাখি নিয়েও। আর কয়দিন পরেই পালিত হবে ঈদ উল আজহা। কষ্টে পড়া এসব বানভাসি মানুষের ঈদ এবার নিরানন্দে কাটবে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে আজকের মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপরদিকে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তারা বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উজান মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীগুলোর পানি বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। বর্তমানে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১ পানি স্টেশনের মধ্যে বাড়ছে ৪৯টির, কমছে ৪৯টির এবং স্থিতিশীল রয়েছে ৩টির। বন্যা আক্রান্ত জেলা ২০টি। বিপদসীমার ওপর দিয়ে ১৯টি নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর বিপদসীমার ওপরে পানি প্রবাহিত হওয়া স্টেশনের সংখ্যা ৩০টি। এদিকে দেশের মধ্যে ভারি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমেছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় সময়ে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টি হয়েছে নোয়াখালীতে ৭৬, কক্সবাজারে ৬৫ ও বরগুনায় ৫২ মিলিমিটার। একই সময়ে বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের দার্জিলিংয়ে ৬৪ ও চেরাপুঞ্জিতে ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মাদারীপুর ॥ মুহূর্তের মধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেল চরাঞ্চলের বাতিঘরখ্যাত শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের নূরুদ্দিন মাদবরকান্দির এস.ই.এস.ডি.পি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ৩ তলা ভবন। বুধবার মধ্যরাতে বিদ্যালয়টির মাঝ বরাবর দ্বিখণ্ডিত হয়ে ঝুঁকে পড়ে। বৃহস্পতিবার সন্ধার কিছুটা আগে বিদ্যালয় ভবনটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। দৃষ্টিনন্দন বিদ্যালয় ভবনটি নদীতে চোখের সামনে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মানতে পারছে না স্থানীয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। এদিকে ২৪ ঘণ্টায় শিবচরের পদ্মায় পানি স্থিতিশীল থাকলেও আড়িয়াল খাঁয় ৬ সে.মি. পানি বৃদ্ধি পেয়ে তীব্র স্রোতে নদী ভাঙ্গন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পদ্মা তীরবর্তী উপজেলার বন্দরখোলা, কাঁঠালবাড়ি ও চর জানাজাতের অবস্থা ভয়াবহ। বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যেই শতাধিক পরিবার গবাদি পশু, মালামাল অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শরীয়তপুর ॥ সুরেশ্বর পয়েন্টে আরও ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শরীয়তপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌ-রুটের শরীয়তপুর অংশে নরসিংহপুর ফেরিঘাট ডুবে গেছে। এতে শরীয়তপুর অংশে দীর্ঘ ১ কিলোমিটার সড়কে আটকা পড়েছে ৩ শতাধিক যানবাহন। কুড়িগ্রাম ॥ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরির্বতিত রয়েছে। ধরলা, তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘ এক মাস ধরে জেলার ৬৫টি ইউনিয়নে ৪০৫টি চর-দ্বীপ চরের প্রায় সাড়ে ৬ শতাধিক গ্রামে সাড়ে ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটােেচ্ছ। এ মানুষগুলো নিজ ঘরবাড়িতে পানির মধ্যে নৌকা, কলা গাছের ভেলা ঘরের মাচানে ও টিনের চালে খেয়ে না খেয়ে দিনের পর দিন রাত কাটাচ্ছে। দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের কর্মজীবী মানুষেরা। প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা না মেলায় খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করছেন তারা। গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে এবং ধীরগতিতে কমছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকাসহ ৬টি ইউনিয়নে পানি ওঠায় লোকজন বিপাকে পড়েছে। অনেক এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। নিচু এলাকার জমিগুলোর আখ, পাটসহ বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাস কর্মকর্তা মোঃ ইদ্রিস আলী জানান, ৬টি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ওসব এলাকার ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। বগুড়া ॥ সারিয়াকান্দিতে যমুনা ও বাঙালীর দুই পয়েন্টেই পানি বেড়েছে। শুক্রবার বিকেলে যমুনার পানি বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার ও বাঙালীর পানি বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে উজানে পাহাড়ী ঢলের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় এবং গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে যমুনা ও বাঙালীর পানি তৃতীয় দফায় বাড়ছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় একদিকে বাঁধে সিপেজ (পানি চুবিয়ে পড়া) বেড়েছে আরেকদিকে ভাঙ্গনের তীব্রতাও বাড়ছে। যমুনার পশ্চিম তীরের ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বগুড়ার ৪৫ কিলোমিটার অংশে ঢলের পানির তোড় বেড়ে গিয়েছে। বালু ভর্তি চটের বস্তা, জিওটেক্স ও সিনথেটিক ব্যাগ বাঁধে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদিকে যমুনা ভেতরের ১৫৮টি গ্রাম বন্যা কবলিত। প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। নীলফামারী ॥ উজানের ঢল কমেছে। তিস্তা নদীর বন্যার পানিও নেমেছে। তবে ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে বসতভিটা, ফসলি জমি ও একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ডিমলা উপজেলার টেপা খড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ময়নুল হক জানান, তিস্তার উজানের ঢলে পানি কমলেও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। তার ইউনিয়নের দুই নম্বর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি বলেন ওই বিদ্যালয়টি আরসিসি পিলারের ওপরে নির্মিত। স্কুল কাম বন্যার সেল্টার সেন্টার হিসেবে ওই বিদ্যালয়টি ভবন তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া তার এলাকার ২৪টি বসতভিটা বিলীন হয়েছে। এক উপজেলার খগা খড়িবাড়ি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন জানান, তার এলাকার কিছামত ছাতনাইয়ের চরটি তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে ২৩ পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিতাস নদীর নবীনগর পয়েন্টে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার, সরাইলের আজবপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের কুরুলিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার এবং গোকর্ণঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রঞ্জন কুমার দাস জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে পানি বৃদ্ধির বিষয়টি নজরদারি করা হচ্ছে। নেত্রকোনা ॥ সাত উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। খুব ধীরগতিতে কমছে বন্যার পানি। শুক্রবার খালিয়াজুরীতে ধনু নদের পানি বিপদসীমার ১শ’ ২১ সেন্টিমিটার এবং কলমাকান্দায় সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অনেক রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও বন্যার পানি রয়েছে। সাত উপজেলার ৩১টি ইউনিয়নের প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। খালিয়াজুরীর ১২টি এবং কলমাকান্দার ২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৬শ’ মানুষ। নওগাঁ ॥ উজানে ভারতের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নওগাঁর জেলার সাপাহার উপজেলার সীমান্তে কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যার পানি ঢুকেছে। গত কয়েক মাস ধরে একটানা বৃষ্টির ফলে উজানে ভারতের নদীগুলো হতে প্রবল বেগে স্রোতের পানি ভাটির দিকে নেমে আসায় হঠাৎ করে সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী, শিরন্টি ও গোয়ালা ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পনি উঠতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই ওই সব এলাকার অনেক ফসলের মাঠ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পানি উঠতে দেখা গেছে। উপজেলার উত্তর পাতাড়ী, জালসুখা, কাউয়াভাসা, কলমুডাঙ্গা, হাপানিয়াসহ বেশ কিছু এলাকার গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। বৃষ্টির পানি বৃদ্ধি হতে থাকলে ভবিষ্যতে ওই এলাকায় বন্যাপরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
×