ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিশ্রুতিশীল কারুশিল্পী আফরোজা খানম মুক্তা

প্রকাশিত: ২০:১০, ২৫ জুলাই ২০২০

প্রতিশ্রুতিশীল কারুশিল্পী আফরোজা খানম মুক্তা

গৌতম পান্ডে ॥ ‘ছোটবেলা থেকে দেখতাম, মা বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন করে নক্সি কাঁথা, কাপড়ের ওপর ফুল, পাখি, ফল ইত্যাদি সুই-সুতা দিয়ে তৈরি করত। মায়ের এসব শিল্পকর্ম দেখে আমি মুগ্ধ হতাম। মায়ের হাতের কাজ দেখে শখ করে আমিও চেষ্টা করতে শুরু করলাম। যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, তখন প্রথম কাপড়ে ফুল তোলা শিখলাম। মায়ের প্রেরণা আর বাবার উৎসাহে আমার মনে নিজের সৃজনশীলতাকে মেলে ধরার বীজ বপন করে দিয়েছিল। যখন উপলব্ধি করলাম, নিজের মেধায় কিছু একটা করতে হবে। তখন থেকে আমার একটাই লক্ষ্য, আমি এমনভাবে বড় হতে চাই, যেন মানুষ আমাকে চেনে। আমিও যেন মানুষের পাশে থেকে ভাল কিছু করতে পারি। আমার প্রশিক্ষণকালীন নিজের আয়ের টাকা দিয়ে গড়ে তুলি ‘শৌখিন কারুশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। এখন আমার এই শৌখিন কারুশিল্পে কাজ করে জীবিকা অর্জন করে সত্তর থেকে আশি জন নারী। নিজের পথচলার সেই কঠিন সময়ের কথা শোনালেন রাজধানীর গোলাপবাগের মেয়ে আফরোজা খানম মুক্তা। নিজের পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে গড়ে তোলা মুক্তার শৌখিন কারুশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এখন শিল্পের এক মাইল ফলক। এখানে শেখানো হয় টেইলারিং, ব্লক-বাটিক, রান্না, পার্লার, আচার, মোমবাতি, পিঠা, পারফিউম, গিফট আইটেমসহ প্রায় ৩৫০টি বিষয়ের ওপর। এখন পর্যন্ত নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি মহিলা। এর পাশাপাশি এখান থেকে যারা প্রশিক্ষণ নেয় তারা এখানে কাজেরও সুযোগ পায়। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে অনেক নারীর। অনেকে আবার দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। মুক্তা বললেন, বিএ ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। পরে স্বামীর অনুপ্রেরণায় যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে রান্নাবিষয়ক বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। শুরুটা ছোট পরিসরে হলেও ১৯৯৬ সালে বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় ব্যবসা ও ট্রেনিং সেন্টারের পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকে। বর্তমানে রন্ধনশিল্প নিয়ে বেশি কাজ করছি। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে যুব উন্নয়ন অধিদফতর, এসএমই ফাউন্ডেশন, ট্রান্সকম ডিজিটাল, সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কারুশিল্প ও হস্তশিল্পের কাজ করছি। তিনি বলেন, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে সাফল্যও আসবে। আমিও আমার পরিশ্রমের মূল্য পেয়েছি। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মকর্মসংস্থানে অবদান রাখার জন্য পেয়েছি ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি স্বর্ণপদক ২০০৯’। ৩২তম সার্ক চার্টার ডে এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার পালসেস প্রতিযোগিতা-২০১৬-তে ছয় বিভাগের মধ্যে দুটি বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করি। ২০১১ সালে ফোকাস বাংলাদেশ ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসেবে পেয়েছি আজীবন সম্মাননা। ২০১০ সালে কারুশিল্প ও রান্নায় বিশেষ অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস গবেষণা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্মাননা পদক, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা সংস্থার ২৭ বছরের শ্রেষ্ঠ ছাত্রী নির্বাচিত হয়েছি। ২০১৭ সালে অর্জন করেছি ট্যুরিজম ও ভয়েস পারফরম্যান্স এ্যাওয়ার্ড। রাওয়া ক্লাবে পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণ করে ১০০ প্রতযোগীর মধ্যে চন্দ্র পুলি পিঠা তৈরি করে প্রথম হয়েছি। বিজনেস গোল্ডেন এ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকবার পুরস্কার পেয়েছি। এ ছাড়া উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মকর্মসংস্থানে অবদানের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে এ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা স্মারক পেয়েছি। মুক্তা বলেন, যেকোন কাজ শুরু করলে বাধা কিছু না কিছু আসবেই। দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নারীদের মনে রাখতে হবে পরিবারের কারোর পরিচয়ে নয়, নিজের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবেই সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
×