ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

নিউ নরমাল বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ২৫ জুলাই ২০২০

নিউ নরমাল বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার চ্যালেঞ্জ

কোভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন অনেক কিছুর সঙ্গেই আমাদের নিত্যই পরিচয় হচ্ছে। আমাদের শব্দ ভান্ডারে যোগ হচ্ছে নতুন-নতুন শব্দ। আজ থেকে তিন-চার মাস আগে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় উঠে এসেছিল তা সম্ভবত ‘কোয়ারেন্টাইন’ আর হালে ‘নিউ নরমাল’। সবকিছুতেই এখন ‘নিউ নরমাল’। গরুর হাট থেকে ডাক্তারি চেম্বার আর দৈনন্দিন বাজার-সদাই থেকে দাফতরিক কাজকর্ম- সবখানেই ‘নিউ নরমাল’-এর দাপট। আজ থেকে দু’বছরের কিছু বেশি সময় আগে যখন সম্প্রীতি বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের পথচলা শুরু, তখন চ্যালেঞ্জটা ছিল একাত্তরের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু কন্যার সহযাত্রী হওয়া। গত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় পুনঃনির্বাচিত করার তাগিদে আমরা আমাদের এই নবীন সংগঠনের ব্যানারে চষে বেড়িয়েছি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। বিভাগীয় শহর আর জেলা শহর তো বটেই, বাদ পড়েনি দেশের প্রধান-প্রধান উপজেলা সদরগুলোও। নির্বাচনোত্তোর বাংলাদেশে কখনও ‘শতবর্ষের পথে বঙ্গবন্ধু’, তো কখনও ‘সম্প্রীতি সংলাপ’, আর এখন এই করোনাকালীন সময়ে ‘অনলাইন সম্প্রীতি সংলাপ’-এর মাধ্যমে আমাদের সেই ক্ষুদ্র প্রয়াস অবিরত চলমান। আজ থেকে বছর দু’য়েক আগে যখন আমাদের চলার শুরু, সেই জায়গাটা থেকে আজকের ‘নিউ নরমাল’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা অনেকটাই ভিন্ন। নিজে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ায় আমার যে প্রায় চৌদ্দ দিনের পথচলা তাতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বনাম অসাম্প্রদায়িকতার চালচিত্র নিয়ে আমার মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। একদিকে আমি যেমন দেখেছি আমার পরিবারের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা হচ্ছে কাকরাইলের তবলিগ মসজিদ থেকে শুরু করে কমলাপুরের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে, তেমনি পাশাপাশি ফেসবুকে কারও কারও ‘হা-হা’ স্ট্যাটাসও দৃষ্টি এড়ায়নি। অবাক হয়ে যেমন দেখেছি মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে মনের উল্লাস চাপতে না পেরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ফেসবুকে নগ্ন স্ট্যাটাস, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন এমন হাস্যকর যুক্তিও দেখেছি নামজাদা বিদেশী প্রচার মাধ্যমের বাংলা ফেসবুক পেইজে। সেখানে আবার একজন অর্বাচীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রবি ঠাকুরের তথাকথিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধিতার ক্যাটাগরি নির্ধারণের দুর্বুদ্ধিতাও দেখিয়েছেন। কোভিড আইসোলেশনে একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এসময়টায় নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করার সুযোগটা পাওয়া যায়। আমি আমার আইসোলেশনটাকে এ কাজে ব্যবহারের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছি। আমার ‘নিউ নরমাল’ উপলব্ধিটা হলো আমরা আজকে যে ভূখন্ডটিকে বাংলাদেশ নামে চিহ্নিত করি একদিকে তার যেমন রয়েছে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য, তেমনি পাশাপাশি এটাও বাস্তবতা যে গত টানা দু’শটি বছরে এই ভূখন্ডে, বড়জোর বিশটি বছর বাদে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুই বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে। এর আনুষ্ঠানিক সূচনা ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে। এরপর হালের বাংলাদেশে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর হাতেগোনা বছরগুলো বাদ দিলে, কি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, কি পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ - সবসময়ইতো এখানে সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুধু পৃষ্ঠপোষকতাই পেয়েছে। পরিস্থিতিটা গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে এতটাই হতাশাজনক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল যে এমনকি বঙ্গবন্ধুকেও নেহায়েত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় তার স্বপ্নযাত্রায় তার সৃষ্টি করা প্রথম পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি জুড়ে দিতে হয়েছিল এবং এই শব্দটিকে ঐ প্রতিষ্ঠানটির নাম থেকে বাদ দিতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দশ বছর। আওয়ামী লীগের প্রথম দু’জন সভাপতিও ছিলেন প্রগতিশীল মওলানা মাত্র। এমনকি ১৯৭০-এর যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অমন ভূমিধস বিজয়, তাতেও নৌকা প্রতীকে সিল মারেনি প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার। সেই হিসেবেই তো আজকের বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ‘লা দিনীয়াত’ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার উর্দু প্রতিশব্দ যার বাংলা অর্থ ‘ধর্মহীনতা’। গত সাড়ে এগারোটি বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের টানা পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তার সঙ্গে সম্প্রীতি বাংলাদেশ আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মতো প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর যার যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো সর্বাত্মক সহযোগিতা বাংলাদেশে অসাম্প্রায়িকতার বাতাবরণটিকে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে এটি যেমন অনস্বীকার্য পাশাপাশি এটিও অনস্বীকার্য যে আমাদের ন্যূনতম আত্মতুষ্টির সামান্যতম সুযোগটিও নেই। মোটা দাগে বিশ্লেষণ করলে এটুকু অন্তত বলা যায় যে, পাকিস্তানকে সামনে রেখে পাকিস্তানপন্থী শক্তির এদেশে পুনঃরুত্থানের সম্ভাবনা হয়তোবা নেই, কিন্তু এটি আগামী চ্যালেঞ্জকে সহজ না করে বরং জটিলতরই করেছে। আর এই জটিলতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক। কোভিডোত্তর যে নিউ নরমাল বাংলাদেশ, আমার ধারণা সেখানে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলার চ্যালেঞ্জটা উন্নীত হবে অন্য মার্গে। সামনে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো হয়ত এদেশে আসবে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে, হয়ত তাদের ভালবাসার নৌকা ডিঙ্গিয়ে যেতে চাইবে পাহাড়ও। কিন্তু পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সেই নৌকা আমাদের কোন ঘাটে নিয়ে ভিড়াবে কিংবা ভালবাসার মোড়কে ভরা তাদের প্রতিষেধকে কি ঠেকাতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই আমাদের কেউ-কেউ সাম্প্রদায়িকতার কি বটিকা যে হজম করে বসবেন সেটি হতে পারে নিউ নরমাল বাংলাদেশে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে যোগ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক শক্তির মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি আর সমঝোতার অভাব। যে সমস্যার সমাধান হতে পারত উপজেলায় সেটিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রাঙ্গণে টেনে এনে কিংবা সাত সাগরের ওপারে ব্রাসেলসে বা নিউইয়র্কে রফতানি করার মধ্য দিয়ে নিপীড়িতের কল্যাণ আসে না। বরং তাতে বাড়ে অভ্যন্তরীণ বিভেদ, পরীক্ষার মুখে পরে পরীক্ষিত বন্ধুত্ব আর শক্তিশালী হয় নব্য সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত। ‘চেনা শত্রুর চেয়ে অজানা শত্রু যে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর’ এটি বাঙালীর চিরায়ত উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিকে আরেক দফা ভাল মতো আত্মস্থ করে নিউ নরমাল বাংলাদেশে নতুন করে ‘দূরে থেকে কাছে আসার’ প্রস্তুতিটা এদেশে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে ধারণ করেন এমন প্রতিটি ব্যক্তি আর সংগঠনকে জোরেসোরে শুরু করতে হবে এখন থেকেই। নচেত বন্ধুর আগামীটা বন্ধুরতরই হবে মাত্র! লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×