ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জয়তু জয় ॥ তব জন্মদিন শুভ হোক নাহি ভয়

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ২৫ জুলাই ২০২০

জয়তু জয় ॥ তব জন্মদিন শুভ হোক নাহি ভয়

১৯৭১ সাল। জাতির পিতার ডাকে বাঙালী জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ লড়ছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। রাজধানী ঢাকার অলি-গলিতে যুদ্ধ চলছে। আমাদের গেরিলারা যত্রতত্র হানাদার পাকি-সেনাদের ঘায়েল করছে, হত্যা করছে। পাকি-সেনারাও ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে রাজপথ অলি-গলিতে টহল দিচ্ছে। যখন তখন যেখানে সেখানে গুলি চালাচ্ছে। জাতির পিতার নির্দেশ এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। আমরাই জিতব। ধানম-ির ১৮ নম্বরের বাড়িটির চারপাশে লোহার গরাদ ॥ গরাদের ওপারে ট্যাঙ্ক কামান সুসজ্জিত পাকি-সেনাদল তাক করে আছে। এরই মাঝে জুলাই ২৭ যে শিশুর জন্ম হলো, মুয়াজ্জিন আজান দিলেন, সে শিশু ৪৯ পার করে ৫০ এ পা রাখবেন। আমাদের স্বপ্ন দেখালেন। নানা স্বপ্ন দেখালেন স্বাধীনতার, এনে দিলেন। মা স্বপ্ন দেখালেন আধুনিক উন্নয়নশীল বাংলাদেশের, গড়লেন। যে শিশুর জন্ম এমনি পরিবেশে তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখালেন বিশ্ব এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে, আমরা কি পেছনে পড়ে থাকব? না, থাকব না। তিনি গড়ে দিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ॥ যে শিশুর জন্ম বেড়ে ওঠা এক ভয়ঙ্কর বৈরী পরিবেশে তার নামই তো জয়। ১৯৭১ সাল। ২৭ জুলাই ধানম-ির ১৮ নম্বরের সাব-জেল। চারদিকে বন্দুক কামান তাক করে দাঁড়িয়ে আছে বর্বর পাকি-সেনাদল। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু ভয়, এই বুঝি মৃত্যু হানা দিল। একটি ট্রিগারই সব শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু না, রাখে আল্লাহ মারে কে? সেই মুহূর্তে আজকের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বরতœ শেখ হাসিনা ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার ঘরে যে শিশুর জন্ম হলো আজকের তথ্য প্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয়। ৪৯ বছর পার করে ৫০ এ পা রাখবেন। জয়তু সজীব ওয়াজেদ জয় তব জন্মদিনে আমাদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আদর অভিনন্দন আপনিই তো জয় মায়ের সঙ্গে বসে স্বপ্ন দেখালেন ডিজিটাল বাংলাদেশের নানা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি জাতি রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার দিয়ে গেলেন মা স্বপ্ন দেখালেন একটি আধুনিক উন্নয়নশীল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত করলেন জয়, আপনার ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। জয় সজীব ওয়াজেদ জয় মুক্তিযুদ্ধের মাঝে জন্ম তাই নানা নাম রাখলেন জয় নাহি ভয় বিশ্ব করবে জয়॥ ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না আমি ভয় করব না’ নানা-নানি মামা-মামি ছিলেন না কেউ কাছে ১৫ আগস্ট ঘাতক বুলেটে রইল না কেউ পাশে॥ তারপর কিছুদিন বাবা-মার কোল তাও বেশি দিন নয় মানুষ যে হতে হবে জ্ঞান- বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ মায়ের মমতা বাবার স্নেহ সে না বোঝার আগেই আলাদা আজ ভারতের দিল্লী কাল নৈনিতাল তারপর দিন কখনো কোদাই কেনেল ব্যাঙ্গালুরু সেন্ট জোসেফ কলেজ তারপর সুদূর সাত সমুদ্রের ওপারে লন্ডন আমেরিকা চলেছেন একা একা সাথে শুধু ছোট বোন পুতুল আর খালা শেখ রেহানা কখনো-সখনো এইভাবে নৈনিতাল পাবলিক স্কুল থেকে বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কখনো বোস্টনের রাস্তায় ভাই বোন পথে পথে কেবলই সঞ্চয় যা কিছু ভালো গ্রহণ করেছেন যা কিছু শেখার শিখেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা মানবতার কথা যেখানে যা পাও কুড়াইয়া লও পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন॥ না হাওয়া ভবন না খাওয়া ভবন না খোয়াব ভবন না মার্শাল ডিস্টিলারি না কোকো ওয়ান টু না কমিশন দোকান নিজেই চাকরি করেছেন কাজ করেছেন পড়ার খরচ জোগাড় করেছেন ভাই বোনের॥ বাবা-মার কাছে শিখেছেন ওসব কোন সম্পদ নয় নয় বাড়ি-ঘর নয় ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকে টাকা মনের বেলায় ঢু ঢু ফাঁকা॥ যে সম্পদ কেউ কেড়ে নিতে পারে না খরচ করেও শেষ করা যায় না বরং বাড়তে থাকে বেড়ে যায় আপনা-আপনি চোর চুরি করে নিতে পারে না ডাকাত ডাকাতি করে নিতে পারে না এ যেমন অর্জনের ব্যাপার তেমনি বিলাবার ব্যাপার যতই করিবে দান, ততই যাবে বেড়ে॥ যে-পথে জয় আজ আইটি সেক্টরে বিশ্বে আড়াইশ’ জনের একজন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জাতিসংঘের অটিজম বিষয়ক এডভাইজার টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ভাবা যায়॥ অথচ দীর্ঘ অনিশ্চিত জীবন। বাংলাদেশের এক নম্বর পরিবারের সন্তান। সেই ১৫ আগস্টের রাতে বিদেশে ছিলেন বলে বেঁচে আছেন কিন্তু বাড়িঘরে জায়গা হলো না। মৃত্যু প্রতিমুহূর্তে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দু’বোনকে। সঙ্গে শিশু সন্তান। জাতির পিতার আদরের কন্যা নাতি-নাতনি অসহায়ের মতো বিদেশের মাটিতে হাঁটছেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। তাদের কি এভাবে পথে পথে হাঁটার কথা? বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানও যে জীবনযাপন করে জয় পুতুল টিউলিপ তাও পাননি। অথচ তারা বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা তৃতীয় বিশ্বের সম্মানীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, কন্যা জামাতা, দৌহিত্র দৌহিত্রী। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধীকে হত্যা করার পর তার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম সফদার জং স্ট্রিটে একটি একতলা ছোট্ট সাধারণ বাড়ি নেই কোন বিদেশী সোফা আসবাবপত্র যা আছে সবই বেতের সবকিছুতে একটা আভিজাত্যের ছাপ ডাইনিং টেবিল চেয়ারও বেতের প্রতিটি ঘরে রয়েছে বুক সেলফ থরে থরে সাজানো বই সবই রাজনীতি সবই অর্থনীতি সবই সমাজবিজ্ঞান সবই বিশ্বসাহিত্য সবই বিজ্ঞান সবই মহাপুরুষদের জীবনী সবই ভ্রমণ কাহিনী আর বিদেশী রাষ্ট্র নেতাদের সঙ্গে ছবি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও একখানা বই তখনও ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়েছিল উপুড় হয়ে হয়তো পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন॥ বঙ্গবন্ধু তো বেশিরভাগ সময় হয় রাজপথ নয় কারাগার। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দোতলা বাড়ি (মূলত দেড় তলা), ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এমনকি বঙ্গবন্ধু কারাগারে গেলে ছাত্রলীগেরও দেখাশোনা করতেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত বা নবাব ফয়েজুন্নিসা বা বেগম সুফিয়া কামালের মতোই অসাধারণ আভিজাত্যসম্পন্ন এই মহীয়সী নারীও ইন্দিরা গান্ধীর মতোই বাড়িটাকে মূল্যবান আসবাবপত্র দিয়ে সাজাননি। একেবারেই সাদামাটা সোফা সেট, ডাইনিং টেবিল, বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘরের টেবিল-চেয়ারটিও ছিল সাদামাটা। মূল্যবান যদি কিছু থাকে সে বই। বঙ্গবন্ধুর পড়ার (নিচতলা) ঘর, দোতলায় তিন ছেলে ও দুই মেয়ের ঘরেও ছিল বই, ছেলেদের ঘরে বাড়তি ছিল খেলার সরঞ্জাম, বল, ব্যাট, শেখ কামালের ঘরে ছিল একটি গিটার ও অন্যান্য মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৩২ নম্বর বাড়িটি আর্মির তত্ত্বাবধানে পরিত্যক্ত ছিল। শেখ হাসিনা পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফেরার পরও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনা তখন রাস্তায় বসে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করেন। অনেক পরে বাড়িটি হস্তান্তর করলে দেখতে গিয়েছিলাম। দেয়ালে দেয়ালে গুলির দাগ, একটি দামী জিনিসও ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিল না। আর তা-ই জয়-পুতুল ববি টিউলিপদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এখানেই তারা মানুষ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য অন্তত ২০ বার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু ওই যে মহাপ্রভু উপরে বসে আছেন তার হাতে জন্ম-মৃত্যু সব। তাই তো ষড়যন্ত্রকারী ভাড়াটে খুনীরা আজ আর মনুষ্য সমাজে নেই। শুধু কি তাই আমেরিকায় জয়কে হত্যা করার জন্য সেখানকার প্রফেশনাল কিলার ভাড়া করা হয়েছিল। আল্লাহপাকের অশেষ কৃপায় সেই ষড়যন্ত্র আমেরিকার গোয়েন্দারাই নস্যাত করে দেয়। আমেরিকার আদালতে তাদের সাজা হয়। এই ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশেরও কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারেন বলে অনেকেরই ধারণা। সেই সন্দেহভাজন ষড়যন্ত্রকারীরাও দেশে থাকতে পারেননি। তবে এটা ঠিক এখন বাংলাদেশে দুর্নীতির হোতাদের যেভাবে ধরা হচ্ছে এরশাদ-খালেদার সময় একইভাবে ধরা হলে দুর্নীতি অনেক কমে যেত। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতিবাজরা ভুল পাল্টে আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে। তারা আর্থিক দুর্নীতি ছাড়াও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার সভাপতি বা পরিচালক হচ্ছেন। কখনও কখনও আমাদের লোকরাই তাদের জন্য সুপারিশ করছেন। আবারও উল্লেখ করছি আগামী ২৭ জুলাই জয়ের ৫০তম জন্মদিন। আমি জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ভয়াবহ কোভিড মহামারীতে কোন উৎসব করবেন না। অবশ্য আগেও করেননি। ঘরোয়াভাবে তিনি নিজ হাতে রান্না করে ছেলেকে খাইয়েছেন। কিন্তু এবার তো কোভিড বা করোনা ভাইরাস সবকিছু তছনছ করে দিল। প্রধানমন্ত্রী এই ভয়াবহতার মধ্যেও প্রতিদিন মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস পরে নিজের অফিস করছেন, কেবিনেট মিটিং করছেন, একনেক বৈঠক করছেন, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১৭ কোটি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কোথায় কোন এলাকার কার ত্রাণ দরকার, কোথায় কৃষকের ঋণ দরকার, দেখছেন। ক্লান্তিবিহীন। তার একমাত্র স্বপ্ন বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে উন্নত দেশে পরিণত করা। তিনি তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু কোভিড এসে কাজের গতি স্লথ করে দিল। কিন্তু তিনি এতটুকু থেমে যাননি। রীতিমতো বরাবরের মতোই কাজ করে যাচ্ছেন। কোভিডের কারণে এবার দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে সেটিও তার চিন্তায় রয়েছে এবং এখন থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। অনেকটুকু এগিয়ে গেছেন। সত্যিই যদি মা ছেলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন না দেখতেন বা ডিজিটাল বাংলাদেশ না গড়ে তুলতেন তাহলে এই যে ভিডিও কনফারেন্স করছেন ভার্চুয়াল মিটিং করছেন সে সবের কি হতো? কিভাবে ১৭ কোটি মানুষের কাছে পৌঁঁছতেন? আজ এই মুহূর্তে মা ছেলের দীর্ঘ সুস্থ জীবনের জন্য আসুন সবাই মহান আল্লাহপাকের কাছে ফরিয়াদ করি এবং শুকরিয়া আদায় করি। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার-এ সস্ত্রীক জয়ের একটি বক্তৃতার কথা দিয়ে শেষ করব। হলভর্তি আইনজীবীদের সামনে প্রথমে বক্তৃতা করেন জয়ের স্ত্রী ক্রিসটিন, তিনিও আমেরিকার আইনজীবী। দু’জনেই ইংরেজীতে বক্তৃতা করলেন। জয় তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির উল্লেখ করে বলছিলেন এক্ষেত্রে বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। আমরা পেছনে পড়ে থাকব না, উই শ্যাল ওভারকাম সাম-ডে। জয় যখন বার বার তর্জনী উঁচিয়ে বক্তৃতা করছিলেন তখন কেবল বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচিয়ে বক্তৃতার কথা মনে পড়ছিল। জয়ও ঠিক নানার মতোই তর্জনী উঁচিয়ে বলছিলেন আমরা এগিয়ে যাবই। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে বক্তৃতা শেষ করলেন। ঢাকা-২৪ জুলাই ২০২০ লেখক : এমপি, সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×