ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিজস্ব চিন্তা-দর্শন পরিস্ফুটনের প্রয়াস

প্রকাশিত: ০০:২৩, ২৪ জুলাই ২০২০

নিজস্ব চিন্তা-দর্শন পরিস্ফুটনের প্রয়াস

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক তরুণ কবি কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহী হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ের বেশিরভাগ প্রবন্ধ পাঠে এটা স্পষ্ট, সমমনা কিংবা একই আদর্শের অনুসারী-লালনকারী অথবা বন্ধুস্থানীয় কবি-সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্য সম্পাদকদের খুশি করতেই স্তূতিসর্বস্ব এসব প্রবন্ধ লিখিত হয়েছে। ফরমায়েশি এসব প্রবন্ধে না মেলে প্রাবন্ধিকদের নিজস্ব চেতনা-দর্শন, না মেলে চিন্তার মৌলিকত্ব। লেখকের বিশ্লেষণী চিন্তার অসারতা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা কি আদৌ সম্ভব? বোদ্ধারা মনে করেন, প্রবন্ধ লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা, প্রখর জ্ঞান ও প্রচুর পাঠাভ্যাস থাকা বাঞ্ছনীয়। সাম্প্রতিক সময়ের প্রবন্ধ পাঠে প্রাবন্ধিকদের মধ্যে উপর্যুক্ত প্রপঞ্চগুলোর অনুপস্থিতি তীব্রভাবে লক্ষ্য করা যায়। আশার কথা হলো, এসব ফরমায়েশি লেখকদের ভিড়ে যে অল্পক’জন তরুণ প্রাবন্ধিক সাহিত্যের গুণাত্মক বিশ্লেষণের পাশাপাশি মৌলিক চেতনাঋদ্ধ প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। কবি-প্রাবন্ধিক সৌম্য সালেক তাদের একজন। সর্বগ্রাসী পাঠক হিসেবে তার ‘শব্দ চিত্র মত ও মতবাদ’ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো পাঠে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অযৌক্তিক হয় না যে, প্রবন্ধগুলোতে তিনি নিজস্ব চিন্তা-দর্শন-মৌলিকত্ব পরিস্ফুটনের প্রয়াস পেয়েছেন। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘আধুনিক বাংলা কবিতা : উচ্চ-শিল্প বিবেচনা’। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, গোটা বিশ্বে এ যাবত কবিতা নিয়ে যত কথা বলা হয়েছে, শিল্প-সাহিত্যের অন্য শাখায় বোধ করি তা হয়নি। আবার, বিশ্বের যত মনীষী কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণের প্রয়াস পেয়েছেন, সাহিত্যের অন্য শাখায়ও এমন ঘটনা বিরল। ফলে কবিতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি আগ্রহের জন্ম দেয়। একজন কবিতাকর্মী হিসেবে কবিতার প্রতি বিশেষ পক্ষপাত এবং আগ্রহের বিষয়টিও আমি বিস্মৃত হতে পারি না। লেখক ‘আধুনিক বাংলা কবিতা : উচ্চ-শিল্প বিবেচনা’ প্রবন্ধে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ও প্রখ্যাত কবি-আলোচকদের মতামত তুলে ধরে কবিতা যে উচ্চ-শিল্প (ঐরময-অৎঃ) তা নিজস্ব দর্শনে বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। কখনও প্রথিতযশা সাহিত্যিক-দার্শনিকের এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় মন্তব্য তুলে ধরেছেন। এ প্রক্রিয়া উৎকৃষ্ট প্রবন্ধের একটি বিশেষ গুণ হিসেবে চিহ্নিত। প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘কালের এবং উপযোগিতার স্থূলতাকে বাদ দিয়ে কলা-কীর্তির যা কিছু মহার্ঘ নির্যাস থাকে তাই উচ্চ-শিল্প (ঐরময-অৎঃ)।’ ‘কবিতায় শব্দপ্রয়োগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ কবিতায় শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বিখ্যাত কবিদের উদ্ধৃতি টেনে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা যুক্তিগ্রাহ্য। এ প্রবন্ধটি লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণী চিন্তার সাক্ষ্যবহ। ইংরেজ কবি এস টি কোলরিজ-এর দুটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে কবিতায় শব্দপ্রয়োগ সংক্রান্ত বিশ্লেষণকে অর্থবহ করে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন কবির প্রথমতই প্রয়োজন শক্তিশালী শব্দভা-ার, শব্দের প্রয়োজনে; এ-জন্য প্রকৃত কবিরা শব্দ-সন্ধানী হয়ে থাকেন।’ এ প্রবন্ধে তিনি কবিতার ছন্দ ও প্রকরণ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি শব্দের অর্থঘনত্ব সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘অর্থঘনত্ব সৃষ্টি এবং ভাবকে স্বচ্ছন্দ রেখে শব্দের নিপুণ বিন্যাসের প্রয়োজনে কেবল তৎসম শব্দই নয়- পুরনো, অপ্রচলিত শব্দ, লোকজ শব্দ, ধর্মীয় শব্দ, আদিবাসীদের ব্যবহৃত শব্দ, মিথ ও কিংবদন্তি অনায়াসে আধুনিক কবিতায় ব্যবহার চলে।’ এছাড়া নতুন সৃষ্টশব্দের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে টীকা সংযোজন জরুরী বলেও মনে করেন। প্রবন্ধটি তরুণ কবিদের জন্য দিকনির্দেশনামূলক বলে মনে করা যেতে পারে। ‘কবিতা ও চিত্রকলা’ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘কবিতা ও চিত্রকলা কিংবা কবি ও শিল্পীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও সাযুজ্যের ইতিহাস অত্যন্ত সুপ্রাচীন।’ পাবলো পিকাসোর ‘কবিতা শিল্পকলারই পরিপূরক। যে কথা রঙে বলা যায় না, সেটা ভাষার অক্ষরে বলা সম্ভব’- উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন, ‘কবিতার মাধ্যম শব্দ এবং চিত্রের উপকরণ রং। দুটো মাধ্যমেই অতীব নৈর্ব্যক্তিকতায় অনুভূতি ও চেতনার নিবিড় অভিনিবেশ ঘটে। কবির দৃষ্টিবদ্ধ চিত্রকল্প প্রকাশ পায় কবিতায় আর শিল্পীর দেখা চিত্ররূপ ফুটে ওঠে ক্যানভাসে। দুই মাধ্যমেরই চিত্রভাষ্য রয়েছে এবং রয়েছে দৃশ্যপট ও শিল্পশৈলীর প্রতিপাদন। কবির অনুভূতির রূপান্তর ঘটে শব্দে এবং শিল্পীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটে ছবিতে।’ কবিতা ও চিত্রকলার তুলনামূলক আলোচনা ও ব্যাখ্যা দিতে তিনি সৈয়দ আলী আহসান থেকে শুরু করে প্রখ্যাত চিত্রসমালোচকদের এ সম্পর্কিত উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যা চিত্রের সঙ্গে শব্দ ও কাব্যের সমন্বিত শিল্প প্রয়াস এবং শিল্পকলাকে বহুভাবে দেখার সুযোগ পাবেন পাঠক। মূলত ‘জীবনকে স্পর্শ করেই শিল্পের উদ্ভব’ ফলে, প্রাবন্ধিক তার যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণী ক্ষমতায় শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের আবর্তকালের সংগ্রাম ও সম্প্রীতির কথকতা নানাভাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন। ‘শব্দ চিত্র মত ও মতবাদ’ গ্রন্থে সূচিভুক্ত অন্য প্রবন্ধ- ‘কাজী নজরুল ইসলাম : সংকীর্ণ মূল্যায়ন’, ‘বরকতুল্লাহ ও রবীন্দ্রবীক্ষায় মানুষের ধর্ম’, ‘গোলাপ ও রক্তনন্দন’, ‘জোসে সারামাগো’র ব্লাইন্ডনেস : এক বিবস্ত্র আখ্যান’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা : কম্পিত স্বরের মূর্ছনা’, ‘দ্বিবার্ষিক এশিয়ান : চারুশিল্পের বিশ্বপট’, ‘শাহাবুদ্দিন : চিত্রকলায় শক্তি ও মুক্তির ভাষ্যকার’, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ : ব্রাত্য মানুষ ব্রাত্য কথাকার’, ‘তিতাশ চৌধুরী : কর্ষিত জমির শস্য’, ‘শান্তনু কায়সার : মননের অনুপম শিখা’, ‘নব্বইয়ের কবিতা : মাতাল মধুগুঞ্জন’, ‘চাঁদপুরের নদী প্রকৃতি ও ইলিশ’, ‘শিল্পকলার বিশ্বায়ন’, ‘কামাল চৌধুরীর কবিতা : প্রেম ও দ্রোহের অভিজ্ঞান’, ‘আমিনুল ইসলামের কবিতায় শিল্প ও নন্দন উপচার’, ‘রুধির লিখন’ এবং ‘আধুনিক শিল্প-সাহিত্য : পথ ও প্রবণতা’। ‘শব্দ চিত্র মত ও মতবাদ’ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো পাঠে এটি স্পষ্ট হয়, বিশ্বসাহিত্য পাঠে প্রাবন্ধিক অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। এ গ্রন্থের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে তিনি কবি-কথাসাহিত্যিকদের রচনার গুণাত্মক বিশ্লেষণ করেছেন, যা পাঠোদ্ধারমূলক রচনা হিসেবে বিশেষভাবে শনাক্তযোগ্য। ‘নব্বইয়ের কবিতা : মাতাল মধুগুঞ্জন’ প্রবন্ধটি নব্বইয়ের কবিতা নিয়ে লিখিত আমার পঠিত সেরা প্রবন্ধগুলোর মধ্যে একটি। নব্বইয়ের কবিতা নিয়ে প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণ গতানুগতিক ও ফরমায়েশি বিশ্লেষণের বিপরীতে ‘অনন্য’ ও ‘উৎকৃষ্ট’ বলেই বিবেচনা করি। এ গ্রন্থের বিশ্লেষণী প্রবন্ধগুলো শিল্পপিপাসু পাঠকদের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও তত্ত্বের যোগান দেবে বলে মনে করি। ‘শব্দ চিত্র মত ও মতবাদ’ গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।
×