ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

পঞ্চকবির অন্যতম ॥ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

প্রকাশিত: ০০:২১, ২৪ জুলাই ২০২০

পঞ্চকবির অন্যতম ॥ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

বাংলা সাহিত্যে পঞ্চকবিদের অন্যতম ছিলেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত গান ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’, ‘বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ’ গানগুলো আজও সমান জনপ্রিয়। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলো বাংলা সঙ্গীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তিনি অনেকগুলো নাটক রচনা করেছিলেন। তাঁর নাটকগুলো সমালোচকগণ চার শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেন- প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। তাঁর রচিত বিখ্যাত ব্যাঙ্গ কবিতা ‘নন্দলাল’ এখনও বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (১৮২০-৮৫) ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। তাঁর বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। তাঁর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন সাহিত্যস্রষ্টা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৭৮ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন এবং ১০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। একই কলেজ থেকে তিনি এফএ পাস করেন। এরপর হুগলি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ম্যালেরিয়াতে প্রায়ই ভুগতেন। এই কারণে শেষের দুটি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। এই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে কৃষিবিদ্যা উপর লেখাপড়ার জন্য সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান। সেখানকার এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায় ঋজঅঝ এবং গজঅঈ ও গজঅঝ ডিগ্রী অর্জন করেন। প্রায় তিন বছর পর ১৮৮৬ সালে তিনি দেশে ফিরে এলে, তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা বিলেতে থাকার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রায়শ্চিত্ত করতে অস্বীকৃতি জানালে, তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়। ১৮৮৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। এই চাকরির সুবাদে তিনি ভূমি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি মধ্যপ্রদেশে সরকারী দফতরে যোগ দেন। ১৮৮৭ সালে প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর প্রথম সন্তান দিলীপ কুমার রায়ের জন্ম হয়। তিনিও পিতার ন্যায় সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত। ১৮৯৮ সালে কন্যা মীরাদেবীর জন্ম হয়। ১৯০৩ সালে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে সুরবালা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাঁকুড়াতে বদলি হন। তিন মাস পরে সেখান থেকে বদলি হয়ে মুঙ্গেরে যান। এই সময় তিনি সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হন। এই সময় তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ক্যালভার্টের কাছে চিকিৎসা নেন এবং এক বছরের জন্য ছুটি নেন। এরপর ১৯১৩ সালের ২২ মার্চ তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার আগে তিনি ভারতবর্ষ নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই পত্রিকা প্রকাশের ভার নিয়েছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স। এই পত্রিকার জন্য তিনি সহকারী হিসেবে নিয়েছিলেন অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। যদিও এই পত্রিকা প্রকাশের আগেই তিনি অসুস্থতা জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। দেশাত্মবোধক গান রচনায়, সুর সংযোগ ও উদাত্ত কণ্ঠের গায়কীতে শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করতে দ্বিজেন্দ্রলালের জুড়ি ছিল না। আত্মীয়-পরিজনদের অনুরোধে জ্বলন্ত স্বদেশপ্রেমের গান লিখে তাঁকে তা নষ্ট করে দিতে হয়েছিল। ইংরেজ সরকারের প্রখর দৃষ্টি তাঁর ওপর বরাবর ছিল। এই গানগুলো রক্ষা পেলে আরও উজ্জ্বল নানা দেশাত্মবোধক সঙ্গীত বাঙালী উপহার পেত। দেশের জন্য, স্বাদেশিকতার টানে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রাণ অস্থির হয়েছে বার বার। মনের ভিতরকার স্বদেশপ্রেমের আঁচটুকু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে স্থির থাকতে দেয় নি। ১৯০৬ সালে দেবকুমার রায় চৌধুরীকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন ‘চাকরি জীবনে ক্রমাগত বদলি আমাকে যথার্থই যেন অস্থির করে তুলেছে। এত বদলি করছে কেন জান? আমার বিশ্বাস স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান, আর ওই প্রতাপসিংহ নাটকই তার মূল। কিন্তু কি বুদ্ধি! এমনি একটু হয়রান করলেই বুঝি আমি অমনি আমার সব মত ও বিশ্বাসকে বর্জন করব?।’ বিশ্বাস, প্রেম আর মনুষ্যত্বই একটা গোটা জাতিকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারে এ কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর মতে দ্বিজেন্দ্রলাল স্বজাতিকে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে যদি দেশের দৈন্য দূর করতে হয় তার জন্য আমাদের মনে ও চরিত্রে যোগ্য এবং সক্ষম হতে হবে, সবল হতে হবে। তাঁর দেশপ্রীতির চরমবাণী এই যে ‘আবার তোরা মানুষ হ।’ হিংসাকবলিত নেতৃ-অধ্যুষিত আমাদের এ সমাজে দেশ ও জাতি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলালের মূল্যায়ন আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। ‘সমাজ বিভ্রাট’ ও ‘কল্কি অবতার’, ‘বিরহ’, ‘ত্র্যহস্পর্শ’, ‘পুনর্জন্ম’ এসব প্রহসন বা নক্শায় সামাজিক অসঙ্গতিকে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় কষাঘাত করেছেন তিনি। এই কষাঘাতের অন্তরালে রয়েছে দেশের প্রতি তীব্র মমত্ববোধ। স্বাদেশিকতার অনুপ্রেরণা যোগাতে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলো রচিত হয়েছিল। জাতিপ্রেমের বাড়াবাড়ি যে অন্য দেশ বা জাতির প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারে এবং স্বজাতির প্রতি তীব্র অন্ধ অনুরাগ ও যুক্তিহীন আনুগত্য মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে এ আশঙ্কাও কবি দ্বিজেন্দ্রলালের মনে উঁকিঝুঁকি দিত। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এ ধরনের স্বদেশপ্রেমকে জলাঞ্জলি দেয়ার কথা বলেছেন বার বার। ‘মেবারপতন’ নাটকে মানসী চরিত্রটি জাতিপ্রেমের সঙ্কীর্ণ চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বিশ্বপ্রেমের দিকে এগিয়ে গেছে। দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলো সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার অসন্তুষ্ট হলেও সরাসরি সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয় নি। তাঁর ‘মেবার পতন’ নাটকে পৃথিবীতে ধর্মের নামে রক্তপাতকে বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এই নাটক লেখার আর কিছুকাল পরে জাতীয়তাবোধের উন্মত্ততায় হিটলারের দানবীয় ধ্বংসলীলা আর পৈশাচিক তা-ব প্রত্যক্ষ করেছিল সারা পৃথিবী। বাংলা নাট্যসাহিত্য, কাব্য ও সঙ্গীত জগতের এই অবিস্মরণীয় প্রতিভা ১৯১৩ সালের ১৭ মে মৃত্যুবরণ করেন।
×