ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুঘরের ছাদের ওপর

প্রকাশিত: ০০:১২, ২৪ জুলাই ২০২০

জাদুঘরের ছাদের ওপর

সবার দৃষ্টি স্থিরভাবে নিবদ্ধ ছিল মহিলাটির দিকে। সে দাঁড়িয়েছিল মিসরের একটা জাদুঘরের ঠিক প্রধান প্রবেশ দ্বারের ছাদের ওপর। কিন্তু কেউই জানে না সে কিভাবে সেখানে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর তাকে দেখে মনে হয়েছে, সে এখনই সেখান থেকে ঝাঁপ দেবে। ভীতিকর অবস্থায় দাঁড়ানো লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গলা কাটা মোরগের মতো দিগি¦দিক দৌড়াতে লাগল। অনেকে চিৎকার করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল; কেউ কেউ আবার সেখান থেকে নিচে নেমে আশার জন্য তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছিল। সে ছিল একজন বেকার ও বিধবা মহিলা। সন্তান সন্ততিদের ভরণ-পোষণের জন্য তার কোন আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। অন্যদিকে দেশে চরম মূল্যস্ফীতির কারণে কারও কাছ থেকে কোন সাহায্যও পাচ্ছিল না। লোক মুখ থেকে সে জানতে পেরেছে, মিসর সরকার আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে ও দমননীতি পরিহার করে মুক্তনীতি চালু করবে। সবাই তা নিয়ে কেন এত বলাবলি করছে সেটা তার জানা ছিল না। সে বিস্ময়ের সঙ্গে এসব শুনছে কিন্তু বুঝতে পারছে না কেন অন্যরা তাদের অনাহারে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে? মহিলাটি একবার অধৈর্য হয়ে তার সন্তানদের হত্যা করে রাতের খাবার হিসেবে খাওয়ার চিন্তা করেছিল। কিন্তু এভাবে বেশি দিন চলা যাবে না ভেবে সে এ সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করে। হঠাৎ জাদুঘরের পরিচালক সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি মহিলার দিকে তাকালেন এবং মনে হলো দু’গালে প্রচ- চড় খাওয়ার মতো আঘাত পেয়েছেন। সেখানে যা ঘটতেছিল তা দেখে তিনি স্বভাবতই খুব বিরক্ত বোধ করলেন। সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল, জাদুঘরে যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশী পর্যটক আসছে ও বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম অনেকগুণ বেড়ে চলছে। ঠিক ওই অবস্থায় এমন একটা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যা আন্তর্জাতিকভাবে আতঙ্ক ছড়াবে ও তাকে এমন একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে তা তিনি ভাবেননি। কিছুক্ষণ পর একটা পর্যটক দল জাদুঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। সবাই স্থির দৃষ্টিতে যে মহিলার দিকে তাকিয়েছিল পর্যটকরা স্পষ্টতই তাকে দেখতে পেল। তখন তিনি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। এই হতাশার মধ্যেও পরিচালক আশান্বিত ছিলেন যে, পর্যটকরা ছাদের ওপর দাঁড়ানো মহিলার বক্তব্য শুনে মনে করবে, সে একটা বদ্ধ উন্মাদ ও অন্যান্য পাগলের মতোই আচরণ করছে। তারা এ বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে অগ্রাহ্য করে চলে যাবে। অবশেষে তার আশা ভঙ্গ হতে বেশি দেরি হয়নি। একজন পর্যটক মৃগী রোগীর মতো ইরেজী ভাষায় গোঙানি শুরু করে দেয়। তাকে দেখে মনে হয়েছে সে যেন মাটি ফেটে তলিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢলে পড়া পর্যটকদের ভিড় চূর্ণ করে তার নিজস্ব গতিতে আসার চেষ্টা করছিল। অভিনব পোষাক, চোখে কালো সানগ্লাস এবং মুখে কঠোর অভিব্যক্তির ভাব নিয়ে এখানে আশা লোকজনদের ছাদের উপর থাকা মহিলাটি লক্ষ্য করে। সে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,তারা যথেচ্ছভাবে রক্তচোষা প্রাণীর চেয়েও আরও অধিক শোষক। একজনের হাতে ছিল হ্যান্ড মাইক। সে কর্তৃপক্ষের ভাষায় মহিলাটিকে অনেক বুঝিয়ে নিচে নেমে আসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এর পরও তাকে নেমে আসার চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। কিছুক্ষণ পর আন্তর্জাতিক পত্রিকার সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে দলে দলে আসতে শুরু করে। ক্যামেরাম্যানরা তার দিকে ক্যামেরা তাক করে রাখে। সে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করে মিসরের ভাগ্যহত মানুষের কথা ও অর্থনৈতিক নীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রা কতটা আশাহীন ও ভয়ঙ্কর অবস্থায় পতিত হয়েছে বিস্তারিতভাবে তা বলতেছিল। শূট পরিহিত আরও লোকজন আসতে শুরু করে। তাদের পূর্বের গম্ভীর মুখাবয়ব হতাশায় বিবর্ণ হতে শুরু করছে। কর্তৃপক্ষের মনোনীত মুখপাত্র তার দাবি কিÑ তা জানতে চাইলেন ও মহিলাটিকে আত্মহত্যার পথ থেকে সরে আসার জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন। হঠাৎ সে ‘টেররিজম এ্যান্ড কেবাব’ ছবির ঘটনা বলতে শুরু করে। ওই ছবির প্রধান চরিত্র বড় একটা ভবন জিম্মি করে রেখেছিল। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসে তাকে তার দাবি পূরণের আশ্বাস দেয়। কিন্তু আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও সে উপলব্ধি করল, প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা পূরণের যে মূল দাবি সে করেছিল তা মানা হয়নি। মহিলাটি নিজেকে ওই ছবির নায়কের মতো মনে করে এবং সে সবাইকে তা জানিয়ে দেয়। সময় চলে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হচ্ছে এক ঘন্টা অতিক্রম করছে। জড়ো হওয়া বিভিন্ন ধরনের লোকজন নিজেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভাই ভাইয়ের মতো অবস্থান করছে। বাস্তব অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে। বিদেশী সাংবাদিকদের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দলসহ অনেকে অন্যসব সাংবাদিকের সঙ্গে যোগ দেয়; যা সে আর গুনতে পারছিল না। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কৌতুক করে চলছে। সরকারী বাহিনী দশগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। মনে হয়, তারা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মনোভাব ছিল খুব চাঙ্গা। সে বুঝতে পেরেছে, সেখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থায় রোমাঞ্চকর এক উত্তপ্ত আবেগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ ধরনের পোষাক পরিহিত লোকজনের সংখ্যা অতি দ্রুততার সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছিল। পুলিশ এসে ওই জায়গাটা খালি করে দেয়। সাংবাদিকরা পুলিশ বেষ্টনীর বাইরে থেকে ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি ও শব্দ রেকর্ড করছিল। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ সাংবাদিক সম্ভবত আরও নতুন কোন কিছুর অপেক্ষায় ছিল। তাই তারা তাদের ক্যামেরায় ধারণকৃত রেকর্ডসমূহ নেটের মধ্যে স্থানান্তর করে পরবর্তী ছবি সংগ্রহ করার জন্য প্রস্তুতি নিতেছিল। অন্য একজন মহিলা সাংবাদিক তার ক্যামেরাম্যান নিয়ে আসে, মহিলাটি লক্ষ্য করে দেখে যে, সে কোন ছবি বা কথা রেকর্ড না করে হাসিমুখে পুরো দৃশ্য উপভোগ করছে। দেখতে দেখতে তাহ্রীর স্কয়ার পদচারী জনতার ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায় ও তৎসংলগ্ন রাস্তাঘাট সম্পূর্ণরূপে অবরূদ্ধ অবস্থায় পরিণত হয়। ছাদ থেকে ওই দৃশ্য দেখে মহিলাটির মনে হয়েছে অগণিত সংখ্যক জীবন্ত লাশ যেন পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। নীচ থেকে প্রায় অর্ধেক লোক কি ঘটতে যাচ্ছে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে পায়নি। সেখানে জনগণের রক্তের ¯্রােত কিভাবে প্রবাহিত হয়েছে সে দৃশ্য সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিল। ফোনের মাধ্যমে এ ধরনের নারকীয় ঘটনার খবর পশ্চিম কায়রো থেকে অতি দ্রুত বেগে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আরও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানোর জন্য হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে খুব শান্তভাবে আবারও মহিলাটিকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে নেমে আসার জন্য কর্তৃপক্ষ বিনীতভাবে অনুরোধ করতেছিল। সাধারণ পোশাক পরা অনেক লোকজন নিচে জমায়েত হয়। তাদের দুরবস্থা দেখে সে অনেক তৃপ্তি পেয়েছে। মহিলাটি অনুভব করছিল, সমাজের উঁচু শ্রেণীর এসব লোকজন যদি তাদের চাকরি হারায় তার জন্য তারা দায়ী নয়। তাদের করুণ ও অসহায় অবস্থা দেখে তার মুখে বিদ্রƒপের হাসি ফুটে ওঠে। হঠাৎ সে ভুলে গেল কেন সে জাদুঘরের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
×