ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গৃহহীনদের দুর্দিন শেষ

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২৪ জুলাই ২০২০

গৃহহীনদের দুর্দিন শেষ

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ নদীর ভাঙ্গন কিংবা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে গৃহহীনদের আর উদ্বাস্তু হয়ে দেশ দেশান্তরে ঘুরতে হবে না। তারা পাবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত আশ্রয়। ছোট্ট স্যাটেলাইট শহরে শুধু ইট-পাথরের আবাসই নয়, থাকবে সংলগ্ন হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিনোদনের ব্যবস্থা। এটি কোন স্বপ্ন নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাস্তবায়ন, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প। কক্সবাজারের খুরুশকুলে বাঁকখালী নদীর তীরে ২৫৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পটি জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় কেন্দ্র। ভবিষ্যতে এটি হয়ে উঠবে দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ঘূর্ণিঝড় ও নদী ভাঙ্গন কবলিত ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সমন্বিত দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ‘একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর বানিয়ে দেয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এই প্রকল্পের আওতায়। ১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওইসব এলাকা পরিদর্শন করে গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। বিশ্বমানের পর্যটন শিল্প বিকাশ ও ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে। বিমানবন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শহরের কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরাটেক ও সমিতিপাড়ায় বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণের আওতায় পড়া জমিতে চার হাজার ৪০৯টি পরিবার বাস করত। এদের দুর্দশার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী সুবিধাজনক এলকায় জায়গা খোঁজার নির্দেশ দেন। জায়গা খুঁজে বের করে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেন। পরে এর নামকরণ করা হয় ‘শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্প’। প্রকল্পে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হবে। যার মধ্যে ‘শেখ হাসিনা টাওয়ার’ নামে একটি ১০ তলা সুউচ্চ ভবনও থাকবে। মোট ফ্ল্যাট হবে প্রায় সাড়ে চার হাজার। পরবর্তী সময় জমি পাওয়া স্বাপেক্ষে এই স্থান অথবা অন্য কোন স্থানে এমন আরও কিছু ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ২০১৫ সালে শুরু হয় মাটি ভরাটের কাজ। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১৯টি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এসব ভবনে এবার ৬শ’ পরিবারকে আশ্রয়ণের আওতায় আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবার এবং নদী ভাঙ্গন ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে গৃহহীনদের জন্য এই প্রকল্পে আশ্রয় দেয়া হবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবায়ু উদ্বাস্তুর আশ্রয়ণ প্রকল্প এটি। ২৫৩ একর জমির প্রকল্পে ১৩৭টি বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই নামকরণ করেছেন ॥ সবচেয়ে আকর্ষণের বিষয়টি হচ্ছে, নির্মিত ভবনগুলোর নামকরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন জানিয়েছেন, কক্সবাজারের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। আবহমান বাংলার প্রকৃতি এবং কক্সবাজারের নানা স্থান নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা নামগুলো হচ্ছে ১) কোরাল, ২) সাম্পান, ৩) রজনীগন্ধা, ৪) হাসনাহেনা, ৫) গন্ধরাজ, ৬) কামিনী, ৭) গোলাপ, ৮) গুলমোহর, ৯) সোনালী, ১০) নীলাম্বরী, ১১) ঝিনুক, ১২) কেওড়া, ১৩) মুক্তা, ১৪) প্রবাল, ১৫) সোপান, ১৬) মনখালী, ১৭) শনখালী, ১৮) দোলনচাঁপা, ১৯) ইনানী ও ২০) বাঁকখালী। কক্সবাজারে চলমান অর্ধশতাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প। এর মাঝে অন্যতম ‘শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্প’র প্রথম পর্যায়ে ১৯টি পাঁচতলা ভবনের চাবি উপকারভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভবন পাওয়া শহরের সমিতিপাড়ার ফাতেমা জানান, আমাদের বাড়িঘর ও জমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য অধিগ্রহণ করার সময় ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা হবে বলে কথা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আজ আমাদের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করে কথা রেখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমারা শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এই প্রকল্পে ॥ খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা পুনর্বাসিত হবে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। পুনর্বাসিত পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, বিনোদনের জন্য পার্ক, স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। স্থানত্যাগ করতে যাওয়াদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী, বিধায় তাদের জীবিকার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আধুনিক শুঁটকি পল্লী নির্মাণ। থাকবে একটি শুঁটকি মহাল। এখানে বিক্রয় কেন্দ্র ও প্যাকেজিং শিল্পও গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি ভবন নির্মিত হবে আধুনিক নগরায়ণ পরিকল্পনায়। নিচতলা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ৫ম তলা বিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত প্রত্যেক তলায় ৮টি করে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের মোট ৩২টি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। এই প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প হবে কক্সবাজার জেলার আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা। কক্সবাজার শহর থেকে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাওয়ার জন্য প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ভেতরের রাস্তা নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য নদীর পাশে ৭ মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের প্রতিটি ফ্ল্যাটে পানি, বিদ্যুত, গ্যাস সিলিন্ডারের সুবিধা থাকবে। প্রকল্প এলাকায় থাকবে ফায়ার স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি। প্রতিটি ভবনের ওপর সৌর বিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করা হবে। সুপেয় পানির জন্য ১০টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। দুটি পুকুর খনন করা হয়েছে। স্কুল তৈরি করা হয়েছে। প্রচুর তালগাছ ও ঝাউগাছ লাগানো হয়েছে। এখানে প্রায় ১০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হবে আধুনিক পর্যটন জোন। এ ছাড়া ১৪টি খেলার মাঠ, সবুজ জায়গা, মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, তিনটি পুকুর, নদীতে দুটি জেটি, দুটি বিদ্যুতের সাবস্টেশন থাকবে। ২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ৩৬ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, তীর রক্ষা বাঁধ, ছোট সেতু, ঘাটলা ও খাল থাকবে পুরো প্রকল্প এলাকায়। আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যারা ফ্ল্যাট পাবেন তাদের ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা হবে।
×