ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যের বিদায়ী ডিজি আজাদের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২৩ জুলাই ২০২০

স্বাস্থ্যের বিদায়ী ডিজি আজাদের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ

নিখিল মানখিন ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদের বিদায় অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে জমেছিল অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পাহাড়সম অভিযোগ। সরকারের হাইকমান্ড থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। অপসারিত হওয়ার আগে তিনি সম্মানজনক বিদায় হিসেবে পদত্যাগের সুযোগটি বেছে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহ জানিয়েছে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তার পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরিয়ে দেয়ার তালিকায় হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক আমিনুল হাসানসহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও কয়েকজন পরিচালক, উপপরিচালক রয়েছেন বলে হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, উপসচিবসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয় সরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদত্যাগপত্র হাতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বুধবার জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসূফ হারুন সাংবাদিকদের বলেন, পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এখন পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। প্রক্রিয়াটি শেষ হলেই পদত্যাগপত্র গ্রহণের বিষয়টি বলা যাবে বলে জানান জনপ্রশাসন সচিব। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগসহ নানাভাবে স্বাস্থ্য সেক্টরের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তিনি অবসরে যান। ডাঃ আজাদের অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) বাতিল করে ওই বছরের ১৫ এপ্রিল তাকে দুই বছরের চুক্তিতে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। এ হিসেবে আগামী বছর ১৫ এপ্রিল তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় ১০ মাস আগেই তিনি সরে গেলেন। গত জুন মাসের শেষ দিকে তাকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। সর্বত্রই গুঞ্জন ছিল ৩০ জুনের পর যে কোন সময় ডিজিকে সরিয়ে দেয়া হবে। মঙ্গলবার তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই গুঞ্জন সত্যি হলো। একটি সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পাশাপাশি নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে সরকারের হাইকমান্ড থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। এরপরই তিনি মঙ্গলবার পদত্যাগপত্র জমা দেন। যে কারণে সরে গেলেন ডিজি ॥ সরকারের হাইকমান্ড মনে করেন, করোনা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ কারণে শুরু থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়ন যথাযথ হচ্ছিল না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিবসহ অন্য কর্মকর্তাদের কেউই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নন কিংবা তাদের এ সম্পর্কিত জ্ঞানও সীমিত। এ কারণে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত মহামারী নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে তারা ডিজির নেতৃত্বে জনস্বাস্থ্যবিদদের ওপরই আস্থা রেখেছিলেন এবং সংক্রামক ব্যাধি আইনেও এ বিষয়টি উল্লেখ আছে। কিন্তু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তিনি সারাদেশের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। শুরু থেকে ডিজি নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব আইইডিসিআর’র ওপর ছেড়ে রেখেছিলেন। অথচ বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা পরীক্ষা কিংবা সংবাদ সম্মেলন করা আইইডিসিআর’র কাজের মধ্যে পড়ে না। আইইডিসিআরের মূল কাজ রোগতাত্ত্বিক গবেষণা করা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংসহ সার্বিক বিষয় মনিটরিং করা এবং সে অনুযায়ী করণীয় সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেয়া। মূল কাজ না করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নমুনা পরীক্ষা ও সংবাদ সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার ওই সিদ্ধান্তটি ছিল চরম ভুল। কারণ একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের হাতে নমুনা পরীক্ষা থাকায় আক্রান্ত সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি করে সর্বত্র রোগটি ছড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ চীনে সংক্রমণের পর সারাদেশে নমুনা পরীক্ষার পরিধি সম্প্রসারণ করলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। একইসঙ্গে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইসোলেশন ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন শয্যা নিশ্চিত করতেও তিনি অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন শয্যা প্রস্তুত থাকার তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিনি যে ফাইল পাঠিয়েছিলেন তা ছিল ভিত্তিহীন। গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক দল তদন্ত করে দেখতে পান যে, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিত্যক্ত ভবন। অনেক ভবনে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাও নেই। এমনকি কোন শয্যাও ব্যবস্থা করা হয়নি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন শয্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। এরপরই টনক নড়ে স্বাস্থ্যবিভাগের। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পাশাপাশি রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড করা হয়। কিন্তু এসব হাসপাতালে দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা নিয়েও স্বাস্থ্যবিভাগ ছিল সিদ্ধান্তহীন। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরে করোনা হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ডাঃ আজাদের আগ্রহেই জেকেজি হেলথ কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজে যুক্ত করা হয়। ওই নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে ওই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। অথচ অনুমোদন দেয়ার আগে ডিজি ওই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তার সেই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সর্বশেষ রিজেন্ট কা- নিয়ে তিনি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিবাদে জড়ান। গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করেন, মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। চুক্তির আগে তিনি সাহেদকে চিনতেন না। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অফিস কক্ষে সাহেদের সঙ্গে একাধিকবার তার বৈঠকের ছবি ভাইরাল হয়েছে। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ডিজিকে কৈফিয়ত তলব করে জানতে চায় মন্ত্রণালয়। সেখানে তিনি সাবেক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের নাম বলেছেন। কিন্তু আসাদুল ইসলাম এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। গত ৯ জুন নিপসমের পরিচালক রিজেন্টে প্রতারণা কথা জানিয়ে ডিজিকে চিঠি দেয়। কিন্তু ৯ জুন পাল্টা চিঠি দিয়ে তিনি রিজেন্ট থেকে দেয়া নমুনা পরীক্ষার কাজ অব্যাবহ রাখতে নিপসম পরিচালককে নির্দেশ দেন। রিমান্ডে সাহেদও ডিজির সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। এই জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতাল টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার মানুষকে করোনার ভুয়া সনদ দেয়। করোনার এসব ভুয়া সনদ নিয়ে বিদেশে গিয়ে তারা পজিটিভ হয়েছেন। এতে করে বিদেশেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। এসব ঘটনায় সরকার ডিজির ওপর ক্ষুব্ধ হয়। কেনাকাটায়ও ছিল দুর্নীতির সিন্ডিকেট ॥ করোনা পরিস্থিতিতে মাস্ক, গ্লাভস, পিপিইসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। প্রথমে এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি আলোচনায় আসে। এন-৯৫ মাস্কের মোড়কে বিভিন্ন হাসপাতালে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছিল। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে বদলি এবং মুগদা মেডিক্যালের পরিচালককে ওএসডি করা হয়। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নি¤œমানের মাস্ক ও পিপিই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে তিনি এসব সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশন দেন। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় গত ২২ মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ শহীদউল্লাহকে সরিয়ে দেয়া হয়। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ে গত ৪ জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে বদলি করা হয়। এরপর অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার দায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় একডজন কর্মকর্তাকে ধাপে ধাপে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল কবীরকে সরিয়ে দেয়া হয়। তিনি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পসহ মোট চারটি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রকল্পে কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে তাকে সরানো হয় বলে স্বাস্থ্যবিভাগ সূত্র জানিয়েছে। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনও ডাঃ ইকবাল কবীরসহ করোনা সংক্রান্ত কেনাকাটায় জড়িত সবার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সচিব ও ডিজির আস্থাভাজন হিসেবে ইকবাল কবীর পরিচিত। এ কারণেই একসঙ্গে তিনি চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছিলেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কেনাকাটায় জড়িতরাও ছিল ডিজির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ॥ সিএমডির মাধ্যমে ৯০০ কোটি টাকার বিভিন্ন চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় জড়িতদের ডিজি সবসময় আগলে রেখেছেন। কেনাকাটার বিস্তারিত তুলে ধরে সিএমএসডি বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ শহীদ উল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, করোনা মোকাবেলায় কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং সিএমএসডি কী কী কেনাকাটা করবে, সে সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর কখনই সঠিক কোন পরিকল্পনা করেনি। ক্রয় প্রক্রিয়া কিভাবে অনুসরণ করা হবে, অর্থের সংস্থান আছে কিনা, স্পেশেফিকেশন কী হবে, কী পরিমাণ সামগ্রী ক্রয় করতে হবেÑ এ সংক্রান্ত কোন দিকনির্দেশনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর থেকে দেয়া হয়নি। এ অবস্থায় সিএমএসডি মৌখিকভাবে বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করে তা হাসপাতালগুলোতে পৌঁছে দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মধ্যে মতবিরোধ ॥ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর। সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই এদের কাজ। মানুষ যখন করোনা চিকিৎসা এবং পরীক্ষা নিয়ে চরম ভোগান্তিতে আছে, তখনই স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে জেকেজির নকল পরীক্ষা সনদের বিষয়টি সামনে এলো। এরপর একে একে প্রকাশিত হলো রিজেন্টের ভয়াবহ জালিয়াতি এবং সর্বশেষ সাহাবুদ্দিন মেডিক্যালের অনিয়ম। এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে অপকর্মের সুযোগ পেল এই প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। শুরু হয় আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। এদিকে মহাপরিচালকের পদত্যাগ স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ঢেলে সাজাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে পদত্যাগ করায় ধন্যবাদ জানাই। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়ে জনমনে অনেক অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে অধিদফতরের কর্তা-ব্যক্তিদের নিয়ে। সেই প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, তার পদত্যাগ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। নতুন ডিজি নিয়োগের বিষয়ে বুধবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদা মালেক, এমপি সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) নিয়োগ দেয়া হবে। আমাদের ডিজি মহোদয় (স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ) পদত্যাগ করেছেন। নিয়ম আছে, সেই নিয়ম অনুযায়ী এটা জনপ্রশাসনে গেছে। জনপ্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী পদক্ষেপ তারা কী নেবেন। নতুন ডিজি নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, পদত্যাগপত্র যেটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গেছে এ বিষয়ে আগে আমাদের কাছে সব সিদ্ধান্ত আসুক তারপর আমরা চিন্তা-ভাবনা করে, আরও উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন কিনা- জানতে চাইলে জাহিদ মালেক বলেন, অবশ্যই সবাই মিলে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব, দরকার হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে নেব বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে ডিজি-এডিজি ॥ এবার সদ্য পদত্যাকারী স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম গণমাধ্যমকে বলেন- জেকেজি হেলথকেয়ারকে অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে তাদের কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। আজ ডিবির একটি টিম স্বাস্থ্য অধিদফতরে গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জানা গেছে, ডিবি কর্মকর্তারা দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরে যায়। তারা আগে থেকে অধিদফতরের ডিজি ও এডিজির সঙ্গে যোগাযোগ করে। ডিবি তাদের জানায়, তারা জেকেজি হেলথকেয়ারকে করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমোদন সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র দেখবে। তাদের সেসব কাগজপত্রগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়। এরপর বিকেলে ডিবির উপপুলিশ কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেলের নেতৃত্বে একটি টিম স্বাস্থ্য অধিদফতরে গিয়ে তাদের কাছ থেকে কাগজপত্রগুলো দেখে যাচাই করে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় জেকেজির বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে অর্থ নিচ্ছিল জেকেজি। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দেয়ার অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল চৌধুরী, তার স্ত্রী ডাঃ সাবরিনা আরিফসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ও সাংবাদিকদের কাছে ডাঃ সাবরিনা কয়েকবার দাবি করেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরে ডিজি জেকেজির বিষয়ে জেনেশুনেই অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি জেকেজির কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে অবগত ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে ডিবি নিশ্চিত জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ জনের রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। আরিফ চৌধুরী জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেকেজির সাত-আট কর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন। নমুনা সংগ্রহের জন্য জেকেজির হটলাইন নম্বরে ফোন করলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেকে জেকেজির বুথে এসে নমুনা দিতেন। বিদেশী নাগরিকদের জন্য নেয়া হতো ১০০ ডলার (প্রায় ৮ হাজার ৫০০ টাকা)। বাংলাদেশীদের জন্য সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। যদিও দাতব্যপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ভিত্তিতে বিনামূল্যে তাদের স্যাম্পল কালেকশন করার কথা ছিল। এসব ঘটনার পর ২৪ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল তা বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
×