ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবনতি অব্যাহত থাকবে

বৃষ্টি বন্যার তীব্রতা বাড়াচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৩ জুলাই ২০২০

বৃষ্টি বন্যার তীব্রতা বাড়াচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উজান থেকে নেমে আসা পানি ও পাহাড়ী ঢলে দেশের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তেমনই দেশের ভেতরে বাড়তি বৃষ্টিপাত বন্যার তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। গত মে মাস ধরে দেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এসে বৃষ্টির গতি আরও বেড়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী আরও কয়েকদিন ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে আগামী প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দেশের আরও পাঁচদিন সব নদ-নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে পারে। এবারের বন্যার সর্বোচ্চ পিকটাইম হতে পারে ২৬ জুলাই। তবে চলমান বন্যা পরিস্থিতি জুলাইয়ের শেষ নাগাদ অব্যাহত থাকতে পারে। এমনকি আগস্টের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তা স্থায়ী হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান দেশের স্বাভাবিক বন্যার সময় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। ফলে এখনই বলা সম্ভব নয় এবারে বন্যা কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। বর্তমানে সব প্রধান নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে চলেছে। আগস্টে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বন্যার স্থায়িত্ব হওয়ার কথা বলা হলেও এই মাসেই পদ্মা নদীর পানি বেড়ে আশঙ্কা থাকে। এদিকে রাজধানী ঢাকার চারদিকে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এই অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ঢাকার চার নদীর পানি দ্রুতই বিপদসীমা অতিক্রম করতে পাারে। এর মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি নারায়ণগঞ্জে আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। তারা জানায়, একই সময়ের মধ্যে ডেমরা পয়েন্টে বালু নদী পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে। মিরপুর পয়েন্টে তুরাগ নদী এবং ধলেশ্বরী নদীর পানি চারদিনের মধ্যেই বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে আগামী পাঁচদিনে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। পদ্মা নদীর পানি আবারও বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে মধ্যাঞ্চলের জেলার বন্যা পরিস্থিতি ২৭ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। একই সঙ্গে এই সময়ের মধ্যে ঢাকার চার নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়বে। এদিকে দেশের সব নদ-নদীর পানি তৃতীয় দফায় বাড়তে থাকায় দেশের উত্তরাঞ্চল-মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলার বন্যা পরিস্থিতি আবারও অবনতি হতে শুরু করেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির কথা বলা হয়েছে। তারা জানায়, সমতলের পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি স্টেশনের মধ্যে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পানি বেড়েছে ৭২টি পয়েন্টে। হ্রাস পেয়েছে ২৮টির, অপরিবর্তিত রয়েছে একটির, বর্তমানে বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১৭টি। ১৯টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজকের মধ্যেই পঞ্চমবারের মধ্যে তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে এবং বালু নদীর ডেমরা পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এবারের বন্যার শুরু থেকে এর আগ পর্যন্ত তিস্তা নদীর পানি চারবার বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এছাড়া ঢাকা জেলার আশপাশের নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। যমুনা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রদ্ধি পেতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গঙ্গাÑপদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল স্থিতিশীল আছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে।। যা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে লরেরগড় ২৪২ মিলিমিটার, মহেশখোলা ২৪০ মিলিমিটার, কক্সবাজার ১৩৯ মিলিমিটার, লালাখাল ১৩৭ মিলিমিটার, ভাগ্যকূল ১৩৩ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জ ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি শরীয়তপুর ॥ বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্লাবিত হয়েছে শরীয়তপুর-মাওয়া সড়ক। সড়কটির বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। সদরসহ নড়িয়া, জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫০টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। নড়িয়া উপজেলার ডগ্রিবাজার, মাঝিরহাট, জাজিরা উপজেলার কাজীরহাট, বিলাশপুর বাজার, খেজুরতলাসহ বহু হাট-বাজার এখন পানির নিচে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫ লক্ষাধিক মানুষ। বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নড়িয়া, জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষ। এখানে শুকনো খাবার, গবাদি পশুর খাদ্য ও বাসস্থানের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এদিকে বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু। ফরিদপুর ॥ বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ১ সে.মি হ্রাস পেয়ে বুধবার সকাল ৬টার দিকে বিপদসীমার (৮.৬৫) ১০৪ (৯.৬৯) সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ৩৫০টি গ্রামের ৩০ সহস্রাধিক পরিবার নিমজ্জিত কিংবা পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্যা দুর্গতদের সাহায্যে উপদ্রুত এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচী শুরু হয়েছে। তবে দুর্গত মানুষের তালমায় বিতরণের হার অনেক কম। রাজশাহী ॥ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন পানচাষীরা। বাগমারা উপজেলার কয়েক শ’ পান বরজ পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষীরা। একমাত্র উপার্জনের জায়গা বন্যায় তলিয়ে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন পানচাষীরা। হাঁটু পানি মাড়িয়ে বরজের পান সংগ্রহ করছেন এখন উপজেলার চাষীরা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় চার শ’ পান বরজে পানি ঢুকে পড়ে। গত সপ্তাহে দ্বীপপুর ইউনিয়নের লাউবাড়িয়া গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে আশপাশের ছয়টি গ্রামে পানি ঢুকে বাড়িঘর, ফসলাদি ও পান বরজের ক্ষতি হয়। এরপর টানা বর্ষণে বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে। কুড়িগ্রাম ॥ পানি আবার বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্রের ধরলায় ও তিস্তায় পানি দ্রুত বাড়ায় নদীর অববাহিকার শতাধিক চরগ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার সারডোবে পরিত্যক্ত বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে প্রবল ¯্রােতে ৪০টি পরিবারের ভিটেমাটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছে গৃহহীন মানুষ। তিস্তার ভাঙ্গনে ঝুঁকিতে পড়েছে গাবুরহেলান স্পারটি। গাইবান্ধা ॥ সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকার বসতবাড়ি একটানা দীর্ঘদিন পানিতে নিমজ্জিত থাকায় কবলিত এলাকার মানুষেরা চরম দুর্ভোগের কবলে পড়েছে। বিশেষ করে কাঁচা ঘরবাড়িগুলো বন্যার পানিতে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছে। এদিকে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া লোকজনরা এখনও বসতবাড়িতে ফিরে যেতে পারছে না। নীলফামারী ॥ তিস্তার পানি প্রবাহ বিপদসীমার ওপরেই রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি (৫২.৬০) বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। মঙ্গলবার (২১ জুলাই) সকালে সেখানে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিকেল ৩টায় পানি কমে ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নওগাঁ ॥ প্রবল বর্ষণে পুনর্ভবা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দু’দিনে নওগাঁর পোরশা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নের জেলেপাড়ার কমপক্ষে ১৯টি বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। এসব বাড়িতে বসবাসরত পরিবারের লোকজন স্থানীয় নিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তলিয়ে গেছে প্রায় ২০ হেক্টর জমির আউশ ধান। হবিগঞ্জ ॥ শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশনের প্ল্যাটফর্মের শেড ফুটো হয়ে আছে অনেক দিন। একটু বৃষ্টি হলেই পানিতে ভেসে যায় পুরো প্ল্যাটফর্ম। এ সময় যাত্রীদের এখানে অবস্থানের কোন সুযোগ থাকে না। এই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি পড়ায় জংশনটিতে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ভিজে জবুথবু হতে হচ্ছে। অথচ তা দেখার যেন কেউ নেই। যাত্রীর এ ব্যাপারে বার বার অভিযোগ করেও কোন ফল পাচ্ছেন না। দুর্ভোগই যেন নিয়তি যাত্রীদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ নদ-নদীর পানি তীব্র গতিতে বাড়ছে। তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী, মৌলভীবাজারের মনু ও হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং টানা বৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পানি চারটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, অব্যাহতভাবে পানি বাড়ার কারণে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মীরসরাই, চট্টগ্রাম ॥ টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে মীরসরাই উপজেলার কয়েকটি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রতিবছর বর্ষা এলে ডুবে যাওয়া এসব গ্রাম প্রায় এক যুগ ধরে এমন দুর্ভোগের শিকার। অথচ কিছু খাল সংস্কার ও জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী উদ্যোগ নিলে এই দুর্ভোগ নিরসন সম্ভব। উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ফেনাফুনি গ্রামে বর্ষাকাল মানেই জলাবদ্ধতা। এবারও কয়েকদিনের টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে গ্রামটি। সরেজমিনে দেখা যায়, জলাবদ্ধতায় ভাসছে এলাকাবাসী।
×