ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্য ব্ল্যাকউডের ধ্রুপদী এক ইনিংস

প্রকাশিত: ০১:৪১, ২২ জুলাই ২০২০

অনন্য ব্ল্যাকউডের ধ্রুপদী এক ইনিংস

করোনাকালে প্রথম মাঠে নেমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যেখানে তুমুল প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ সাউদাম্পটন টেস্টে ৪ উইকেটের স্মরণীয় এক জয় তুলে নেয় সফরকারী ক্যারিবিয়ানরা। প্রাণ ফেরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। বহুল আলোচিত ম্যাচে ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ের পথে ৪২ রানে ৬ উইকেট নিয়েছেন অতিথি অধিনায়ক জেসন হোল্ডার। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা পেসার শ্যানন গ্যাব্রিয়েল। এসবই মানুষ মনে রাখবে। আর শেষ দিনে ২০০ রানের টার্গেটে জয়ের নেপথ্যে নায়ক হয়ে থাকবেন জার্মেইন ব্ল্যাকউড। মাত্র ৫ রানের জন্য ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পাননি। আউট হয়েছেন ৯৫ রানে। ১৫৪ বলের ইনিংসটি সাজিয়েছেন ১২টি চার দিয়ে। তার অনবদ্য ব্যাটিংই মূলত শেষ দিনের শেষ বেলায় উইন্ডিজকে এনে দেয় মনে রাখার মতো এক জয়। ইংল্যান্ডের মতো কঠিন সফরে সিরিজের প্রথম টেস্ট জিতে এগিয়ে যাওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ ধারাভাষ্য কক্ষে গ্রেট মাইকেল হোল্ডিং বার বার সেটিই বলছিলেন। ক্যারিবীয়দের দারুণ এ জয়ের প্রশংসা করতে গিয়ে শচীন টেন্ডুলকর সবার আগে ব্ল্যাকউডের কথাই বলেছেন। জয় থেকে ১১ রান দূরে থাকতে ৯৫ করে আউট হয়ে ফেরেন এই ক্যারিবিয়ান। পাঁচ বছর পর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির হাতছানি স্পর্শ করতে পারেননি ব্ল্যাকউড। তবে শতক নয়, ব্ল্যাকউডের বড় আক্ষেপের জায়গা ম্যাচ শেষ করে আসতে না পারা। দুর্দান্ত খেলছিলেন, কিন্তু ১১ রান দূরে থাকতে স্টোকসের বলে মিড অফে ক্যাচ তুলে ফিরেছেন তিনি। এমনভাবে আউট হয়ে হতাশায় পুড়েছেন জানিয়ে ব্ল্যাকউড বলেন, ‘খেলার এমন পর্যায়ে আউট হওয়ার পর আমার খুব হতাশ লাগছিল। আউট হয়ে আমি খুব আবেগী হয়ে পড়েছিলাম। আমি শতক নিয়ে একদমই ভাবছিলাম না। আমি কেবল দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে চেয়েছিলাম। আর দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে না পারায় আক্ষেপে পুড়ছিলাম আমি।’ বরাবরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভাল খেলা ব্ল্যাকউড যখন চতুর্থ ইনিংসে মাঠে নামেন ততক্ষণে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে। তাও মাত্র ২৭ রানের মধ্যে। কিন্তু তাতেও সাহস হারাননি ব্ল্যাকউড। জানিয়েছেন, কোচ ফিল সিমন্স এবং অধিনায়ক জেসন হোল্ডার তাকে নিজের স্বাভাবিক খেলাটাই খেলে যেতে বলেছিলেন। ব্ল্যাকউডের ভাষ্য, ‘আমি যখন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে যাই, এক মুহূর্তের জন্যও আমি চাপ অনুভব করিনি। আমি যখন ব্যাটিংয়ে নামব, তখন কোচ এবং অধিনায়ক ডেকে বলল, আমি যেন আমার স্বাভাবিক খেলাটাই খেলে যাই। কেবল শট নির্বাচনে একটু সাবধান থাকতে বলেছিল।’ বয়সভিত্তিক দল থেকে একসঙ্গে অধিনায়ক হোল্ডারের সঙ্গে খেলে আসছিলেন ব্ল্যাকউড। ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক জানতেন ব্ল্যাকউড ভাল খেলবেন। আর এমন বিশ্বাস তার অনুপ্রেরণা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন জানিয়ে ব্ল্যাকউড বলেন, ‘যখন আপনি জানবেন আপনার অধিনায়ক আপনার উপর সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী। সেটি তখন আপনাকে আলাদা অনুপ্রেরণা জোগাবে। অনুর্ধ-১৫ এর বয়সভিত্তিক দল থেকে হোল্ডার আমার উপর ভরসা করে। সে জানে আমার পক্ষে কি করা সম্ভব।’ হ্যাঁ অনেকের মনেই প্রশ্ন ইংল্যান্ডের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে মনে রাখার মতো এক জয় এনে দেয়া কে এই ব্ল্যাকউড? এর আগে ২৮ টেস্ট খেললেও ডানহাতি ব্যাটসম্যান খুব একটা নজর কাড়তে পারেননি। জ্যামাইকার ২৮ বছর বয়সী মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান একজন সহজাত স্টোকমেকার। তেড়েফুড়ে ব্যাটিং করতে বেশ পছন্দ করেন। তবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে রয়েছে তার বিশেষ আগ্রহ। এরই মধ্যে খেলেছেন ১০০টিরও বেশি ম্যাচ। ২০১৩-১৪ মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান করে দলে জায়গা পান ব্ল্যাকউড। এরপর ২০১৪ সালের জুনেই তার মাথায় ওঠে আভিজাত্যের টেস্ট ক্যাপ। অভিষেকে তার ব্যাট থেকে আসে ৬৩ রান। সেটা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নয় হাফ সেঞ্চুরি ও এক সেঞ্চুরিতে দলের সঙ্গেই ছিলেন ব্ল্যাকউড। পরের পাঁচ টেস্টে মাত্র ১৫ রান করলে দল থেকে বাদ পড়েন। মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখা শুরু ব্ল্যাকউডের। তবে দমে যাননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে শক্তিশালী পারফর্মেন্সের কারণে জাতীয় দলের আশপাশেই ঘোরাফেরা করতে থাকেন। ২০১৯ সালে কনকাসন সাবে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর আবার সাউদাম্পটনে মাঠে নামলেন। অটোমেটিক চয়েজে সাউদাম্পটনে মাঠে নামেন ব্ল্যাকউড। ২০২০ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে আট ম্যাচে জ্যামাইকার হয়ে ৭৬৮ রান করেছেন। তার থেকে বেশি রান অন্য কেউ করেননি। শেষ ম্যাচে লিওয়ার্ড আইসল্যান্ডের বিপক্ষে তার ডাবল সেঞ্চুরি ছিল অনন্য, অসাধারণ। ওই ইনিংস দেখার পর নির্বাচকরা তার থেকে চোখ সরাতে পারেননি। তবে অটোমেটিক চয়েজ হওয়ার পেছনে বড় ঘটনাও আছে। করোনার ভয়ে ইংল্যান্ড সফর থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন শিমরন হেটমায়ার ও ড্যারেন ব্রাভো। দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের অনুপস্থিতিতেই মূলত ব্ল্যাকউডের কপাল খুলে যায়। ইংল্যান্ড বরাবরই ব্ল্যাকউডের প্রিয় প্রতিপক্ষ। এর আগে ২০১৫ সালে একবার ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন ব্ল্যাকউড। সেবার ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট শতক পান। পাশাপাশি টেস্ট ক্যারিয়ারের ৪১ শতাংশ রান পেয়েছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই। সাউদাম্পটনে ৯৫ রানের ইনিংসের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার ব্যাটিং গড় ৫৫! টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে জানিয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নামছেন তিনি। ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করলেও এই ইনিংসের মধ্য দিয়ে ব্ল্যাকউড শুধু নিজেকে প্রমাণই করেননি, দলকে দিয়েছেন অনেক বড় সাফল্য। নিজের ব্যক্তিগত সাফল্যের রহস্য জানাতে গিয়ে ব্ল্যাকউড বলেছেন, ‘দুই থেকে আড়াই বছর আমি দল থেকে বাইরে ছিলাম। তখনই ভাল করার জেদ চেপে বসে। এই সুযোগটি আমার কাছে এসেছে, আমি দুই হাত ভরে তা লুফে নিয়েছি। বিশ্বের সেরা পেসারদের বিপক্ষে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধেও ধারাবাহিক রান করতে হবে।’ ২০১৪ থেকে ২৯ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৩১.২৫ গড়ে ১৪৬৯ রান করেছেন জ্যামাইকা থেকে উঠে আসা ডানহাতি মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান ব্ল্যাকউড।
×