ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জিদানের জাদুতে রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্ব

প্রকাশিত: ০১:৪০, ২২ জুলাই ২০২০

জিদানের জাদুতে রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্ব

যুগে যুগে রিয়াল মাদ্রিদে খেলেছেন বিশ্বের সেরা সেরা তারকা। একটা সময় দলটিতে এত বেশি তারকার আধিক্য ছিল যে, বলা হতো তারার হাট। এ কারণে রিয়ালের ডাক নাম হয়ে গেছে ‘গ্যালাক্টিকো’। সেই দলটি এবার ২০১৯-২০ মৌসুমে স্প্যানিশ লা লীগায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তবে এই দলটিকে ঠিক তারার হাট বলা যাবে না! ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সান্টিয়াগো বার্নব্যু ছাড়ার পর গড়পরতা মানের খেলোয়াড়দের নিয়েই সফল হয়েছে লস ব্লাঙ্কোসরা। এই সাফল্যের মূল কারিগার তারকা কোচ জিনেদিন জিদান। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ মানেই রিয়ালের একতরফা প্রাধান্য। স্প্যানিশ জায়ান্টরা এ পর্যন্ত ইউরোপীয়ান ক্লাব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসরে সর্বোচ্চ ১৩ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ইউরোপ সেরার মতো স্পেনের ঘরোয়া লীগেও একচ্ছত্র আধিপত্য গ্যালাক্টিকোদের। কিন্তু সবশেষ দশ বছরে এই আধিপত্যে বেশ ছেদ পড়েছিল। এটা হয়েছিল লিওনেল মেসির কারণে। আর্জেন্টাইন জাদুকরের ছোঁয়ায় ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত লা লিগায় ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বার্সিলোনা। এর মধ্যে রিয়াল জিতেছে মাত্র তিনবার। একবার অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। কিন্তু লীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শ্রেষ্ঠত্বে রিয়ালের ধারেকাছে নেই কোন ক্লাব। এমনকি তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সিলোনাও। ১৬ জুলাই রাতে নিজেদের অনুশীলন মাঠ আলফ্রেডো দ্য স্টেফানোতে ভিয়ারিয়ালকে ২-১ গোলে হারিয়ে লা লিগার ২০১৯-২০ মৌসুমের শিরোপা জিতে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। দুর্দান্ত জয়ে দলটির হয়ে জোড়া গোল করেন ফরাসী ফরোয়ার্ড করিম বেঞ্জামা। দুই বছর পর শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করা রিয়ালের এটা লীগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৩৪তম ট্রফি জয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বার্সিলোনা। আর তিনে থাকা এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের শোকেসে জমা ১০টি ট্রফি। ফরাসী কিংবদন্তি জিনেদিন জিদানের কোচিংয়ে এ নিয়ে ১১তম শিরোপা জিতেছে রিয়াল। ক্লাবটির হয়ে প্রথম মেয়াদে ৯টি। দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেয়ার পর এটিসহ দুটি। গত জানুয়ারিতে স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতেছিল জিদানের দল। করোনাভাইরাস বিরতির পর পুনরায় মাঠে গড়ানো লীগে শুরুতে বার্সিলোনার চেয়ে দুই পয়েন্ট পিছিয়ে ছিল রিয়াল। ‘নতুন রূপে’ ফেরা লীগে তারাও যেন ফেরে নতুন চেহারায়। ফেরার পর ১০ ম্যাচ খেলে সবকটিতেই জিতেছেন রামোস-বেঞ্জামারা। কিন্তু শেষটা আর রাঙাতে পারেনি জিদানের শিষ্যরা। ১৯ জুলাই এবারের মৌসুমের শেষ দিনে লেগানেসের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে রিয়াল। আর বার্সিলোনা ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় আলাভেসকে। মৌসুম শেষে প্রতিটি দল ৩৮টি করে ম্যাচ খেলেছে। চ্যাম্পিয়ন রিয়ালের ভা-ারে জমা পড়েছে সর্বোচ্চ ৮৭ পয়েন্ট। রানার্সআপ বার্সিলোনার পয়েন্ট ৮২। ৭০ পয়েন্ট করে নিয়ে হেড টু হেডে এ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তিনে ও সেভিয়ার অবস্থান চারে। দলগুলো আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে খেলা নিশ্চিত করেছে। এবারের লীগ থেকে তিনটি দলের দ্বিতীয় বিভাগে অবননম হয়েছে। দলগুলো হলো সবার নিচে থাকা এস্পানিওল, মায়োর্কা ও লেগানেস। দল তিনটির পয়েন্ট যথাক্রমে ২৫, ৩৩ ও ৩৬। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর রিয়ারের গর্বিত কোচ জিনেদিন জিদান বলেন, আমার পেশাদার ক্যারিয়ারে এটি অন্যতম একটি সেরা দিন। লকডাউন ও পরবর্তীতে সবকিছুর পর এই শিরোপা সত্যিই স্মরণীয়। দলটির অধিনায়ক সার্জিও রামোস বলেন, এতদিন আমরা যা করেছি তার পুরস্কার পেয়েছি। শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করে রিয়াল উচ্ছ্বাসে ভাসলেও বিপরীত চিত্র বার্সিলোনা শিবিরে। দলটিতে এখন গৃহবিবাদ ওপেন হয়ে গেছে! দলটির কোচ কিকে সেটিয়েনের ছাঁটাই হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কাতালানদের সেরা তারকা লিওনেল মেসি নিদারুণ হতাশ দল নিয়ে। রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে মেসি বলেন, তারা (রিয়াল) যোগ্য দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাদের অভিনন্দন। এখন আমাদের সবকিছু নতুন করে ভাবতে হবে। সব কিছুর অবশ্যই পরিবর্তন করতে হরে। এবারের মৌসুমে যা কিছু হয়েছে তা নিয়ে ক্লাবের প্রতিটি মানুষই বিরক্ত। আর এটাই স্বাভাবিক। খেলোয়াড়দের অনুভূতিটাও একই। আমাদের অবশ্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। খেলোয়াড়দের থেকে শুরু করে যা পুরো ক্লাবের জন্যই প্রযোজ্য। বর্তমান ফিফা সেরা তারকা আরও বলেন, অনেক দিন আগেই আমি বলেছিলাম এভাবে চলতে থাকলে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে জয় পাওয়াটা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়বে। আর এখন লা লিগায় তাই ঘটেছে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আমাদের লড়াই করতে হলে অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ তা নাহলে নেপোলির কাছে হার নিশ্চিত। ২০১৮ সালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো দলছুট হওয়ার পর রিয়াল মাদ্রিদের কর্তাব্যক্তিসহ সমর্থকদের কপালে পড়েছিল দুশ্চিন্তার ভাজ। এটি আরও ঘনীভূত হয়েছিল ওই বছরেই কোচ জিনেদিন জিদান সান্টিয়াগো বানাব্যু ছাড়লে। এরপর গ্যালাক্টিকো শিবিরে ভর করে নিদারুণ হতাশা। সঙ্গী হয় ব্যর্থতাও। যে কারণে ২০১৯ সালে আবারও জিদানকে ফিরিয়ে আনে লস ব্লাঙ্কোসরা। ফেরাটা যে বৃথা যায়নি সে প্রমাণ ফরাসী গ্রেট ভালভাবেই রেখে চলেছেন। প্রত্যাবর্তনের পর গত জানুয়ারিতে রিয়াল মাদ্রিদকে উপহার দেন প্রথম ট্রফি। এবার পুনরুদ্ধার করে দিলেন লা লিগার মুকুট। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সিলোনার কাছ থেকে ট্রফি নিজেদের শোকেসে ফিরিয়ে এনেছেন ফ্রান্সের হয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী এই সুপারস্টার। তবে মাঠের লড়াইয়ে জিদানকে যোগ্য সাপোর্ট দিয়েছেন দুই তারকা সার্জিও রামোস ও করিম বেঞ্জামা। একজন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হয়েও রক্ষণ সামলে রামোস যেভাবে নিয়মিত গোল করেছেন সেটা রীতিমতো বিস্ময়কর। আর রোনাল্ডো বার্নাব্যু ছাড়ার পর সেই জায়গাটা ভালমতোই পূরণ করেছেন ফরাসী তারকা বেঞ্জামা। তাকে তো এই মুহূর্ত লিওনেল মেসির চেয়েও ভাল বলা হচ্ছে! রিয়ালের শিরোপা তাই জয়ে পুরো দলের কৃতিত্ব থাকলেও মূলত জিদান-রামোস-বেঞ্জামা এই তিন তারকার অবদানই সবচেয়ে বেশি। জিদান খেলোয়াড়ি জীবনে জিতেছেন সম্ভাব্য প্রায় সব শিরোপা। কোচ হিসেবেও একের পর এক সাফল্য নিজের করে নিচ্ছেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জিদান খেলোয়াড় হিসেবেও মাঠ মাতিয়েছেন রিয়ালের পক্ষে। এখন কোচ হিসেবেও নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০১৬ সালে কোচ হিসেবে রিয়ালের দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৮ সালে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এক বছর পর আবারও ফিরেছেন কোচ হিসেবে। এই অল্প সময় রিয়ালের হয়ে ১১টি শিরোপা জিতেছেন জিদান। এই শিরোপা জিততে মাত্র ২০৯ ম্যাচ ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন তিনি। অর্থাৎ ম্যাচ ও শিরোপার অনুপাতে প্রতি ১৯ ম্যাচে একটি করে শিরোপা জিতেছেন ৪৮ বছর বয়সী জিদান। ২০১৬ সালে মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে রিয়ালের ক্রান্তিকালে যুব দলের দায়িত্ব ছেড়ে মূল দলের কোচ হয়েছিলেন জিদান। তখন টানা তিন মৌসুমে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে ২০১৮ সালে ছেড়ে দেন দায়িত্ব। তবে পরের বছরই আবার ধরেন দলের হাল এবং জিতে নিলেন ২০১৯-২০ মৌসুমের লা লিগা। সবমিলিয়ে কোচ হিসেবে জিদানের শিরোপাগুলো হলো ২টি লা লিগা, ২টি স্প্যানিশ সুপার কাপ, ২টি উয়েফা সুপার কাপ, ২টি ক্লাব বিশ্বকাপ এবং ৩টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। রিয়ালের হয়ে শিরোপা জয়ে তার সামনে রয়েছেন শুধুমাত্র মিগুয়েল মুনোজ। যিনি রিয়ালকে ৬০৫ ম্যাচে কোচিং করিয়ে জিতেছেন ১৪টি শিরোপা। রোনাল্ডো চলে যাওয়ার পর রিয়ালের আক্রমণভাগ একাই সামলাচ্ছেন বেঞ্জামা। নিজে গোল করছেন আবার সতীর্থদের দিয়ে করাচ্ছেন। আক্রমণ গড়ে দিচ্ছেন প্লেমেকারের ভূমিকায়। আবার নিজের স্ট্রাইকার পরিচয়ও ভুলছেন না। এই প্রথম রিয়ালের জার্সিতে টানা দুই মৌসুম ২০ এর বেশি গোল করেছেন। ২১ গোলের সঙ্গে এবারের মৌসুমে গোলে সহায়তা করেছেন আটবার। সবচেয়ে বেশি গোল করা মেসি করেছেন ২৩টি। কিন্তু জিততে পারেননি ট্রফি। যে কারণে বেশি গোল করলেও অন্তত এবারের মৌসুমের মেসির চেয়ে বেঞ্জামাকে সেরা বলছেন অনেকে। রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্টিনো পেরেজ ফরাসী তারকার প্রশংসা করে বলেন, বেঞ্জামার ব্যালন ডি’অর জেতা উচিত। এ বছর বা গত বছর ওর চেয়ে ভাল কাউকে খেলতে দেখিনি। নায়ক বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। বরং বলা চলে মহানায়ক। সার্জিও রামোস এখন ঠিক এমনই। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে একের পর এক গোল করছেন আর গড়ছেন কীর্তি। একজন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হয়ে স্প্যানিশ তারকা মুড়ি মুড়কির মতো গোল করেছেন এবারের লীগে। গোলগুলোর আবার বেশিরভাগ পেনাল্টি থেকে। লা লিগায় বিলবাওয়ের বিরুদ্ধে লক্ষ্যভেদ করে স্পেন জাতীয় দল ও রিয়ালের হয়ে টানা ২২টি পেনাল্টি থেকে গোল করার রেকর্ড গড়েন রামোস। লা লিগায় ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমের পর প্রথম সেন্টারব্যাক হিসেবে ন্যূনতম ১০ গোলের দেখাও পেয়েছেন। ২০০৫ সালে সেভিয়া থেকে রিয়ালে যোগ দেয়ার পর দলটির অন্যতম সেরা তারকা তিনি।
×