ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সারিয়াকান্দির চার চরগ্রাম যমুনার পেটে

বানভাসি মানুষের অস্তিত্বের লড়াই

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ২২ জুলাই ২০২০

বানভাসি মানুষের অস্তিত্বের লড়াই

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ করোনার ভয়ের চেয়ে যমুনার ভয়াল ¯্রােতের ভয়ই কাহিল করে ফেলেছে যমুনার তীর ও চরগ্রামের লাখো মানুষকে। জীবনজীবিকা, বসতভিটা, সহায়সম্বল, জমিজিরাত সবই পাহারা দিতে হচ্ছেÑ কখনও বানভাসি কখনও ভাসমান। ঘরগৃহস্থালি : কখনও নৌকায়, কখনও বাঁধের ওপর, কখনও ভিনগাঁয়ের শুকনো ভূমির ওপর চাটাইয়ের ঝুপরি বানিয়ে। উত্তাল যমুনা তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় নিত্যবছর বর্ষা মৌসুমে। তবে এবার গত দশ বছরের চেয়ে অনেক বেশি। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার ফেরে মানুষের দিন কাটছে আতঙ্কে। এরই মধ্যে যমুনার তা-বে মুহূর্তেই চারটি চরগ্রাম তার পেটে। গভীর ¯্রােত ধাক্কা দিয়ে অন্তত চার হাজার মানুষকে অন্য তীরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই দৃশ্য বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার পূর্বে দূরের যমুনা ও বাঙালী তীরের সারিয়াকান্দি উপজেলার। সেখান থেকে আরও কয়েক কিলোমিটার ভেতরে নৌপথে গেলে দেখা যাবে মানুষের দুর্ভোগ, অসহায়ত্বের এক নির্মম চিত্র। উপজেলার ১২ ইউনিয়নের ৯টিই চর এলাকা। অর্থাৎ যমুনার বুকের ওপর জেগে থাকা। দুর্গম ৩৮টি চরের মধ্যে চালুয়াবাড়ি, ফাজিলপুর, আউচারপাড়া, শিশুরতাইড়, কাঁকলিহাটা, হাটবাড়ি, বিয়ামের পাঁচগাছি, দলিকা, মানিকদাইড়, সুজালিপাড়া,বহুলাডাঙ্গা, খাটিয়ামারী, ঘুঘুমারী, চক রথিনাথ, রৌহাদহ, পাকুরিয়া, নিজ তিতপরইল, মথুরাপাড়া, ধলিরকান্দি, কুতুবপুর, কামালপুর ও ধনারচরের মানুষ নিত্য প্রহর গোনে; কখন পানি নেমে যাবে বা সরে যাবে। এবার সহজে তা নামছে না। এরই মধ্যে এক সপ্তাহে ধনারচর ও আউচারপাড়া যমুনার পেটে চলে গেছে। বংশপরম্পরায় চরগ্রামের মানুষ নদীর গতিবিধি দেখে বুঝতে পারে ভূমির ওপর তারা টিকবে কিনা। তারা আগেই সরে পড়ে। এবারও কিছুটা দূর থেকেই দেখেছে তাদের ভূমি চোখের পলকেই কেড়ে নিল যমুনা। আউচারপাড়ার রোস্তম আলী বললেন ‘আক্ষুসি নদী হামাগেরক তো বাঁচপ্যার দেয় না। কুমিড়ের লাগান গিলো খায়’ (রাক্ষসি যমুনা নদী তো আমাদের বাঁচতে দেয় না। কুমিরের মতো পেটে ভরে)। ধনারচরের মোজাম পাইকার বললেন ‘ভিটা গেল। জমিগুলান গেল। হাটত ঘর তুলে ব্যবসা করিচ্চিলাম তাও গেল। আক্ষুিস যমুনা আর কত খাবু খা’ (বসত গেল। জমি গেল। হাটে ঘর তুলে ব্যবসা করছিলাম তাও গেল। রাক্ষসি যমুনা আর কত খাবি খা)। যমুনা তীরের বন্যাÑ ভেসে থাকা অনেক মানুষ গাদাগাদি হয়ে থাকছে ঝুপরি ঘরে। কেউ বেদের বহরের মতো নৌকার ছইয়ের নিচে। এদের ঘরে খাট, আসবাবপত্র, চুলা, ঘরগেরস্থালি সবই ছিল। এগুলোর অর্ধেক কোন রকমে নৌকায় তুলে ক্ষণিকের আশ্রয়ে গেছে। মানুষ, গবাদিপশু সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড় একসঙ্গে থাকছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সন্ধানে কলসি মাথায় দূরে যাচ্ছে। এদের মধ্যে করোনার ভীতির চেয়ে বড় ভীতিÑ কি করে টিকে থাকবে, কি করে যুদ্ধ করবে বন্যার সঙ্গে; অস্তিত্বের জন্য লড়াই করতে জানে এরা। দেখা যায়-বাড়িগুলো সব ডুবে গেছে, টিনের চালার কিছু অংশ জেগে আছে। একখ- শুকনো ভূমি নেই। নৌকায় জিনিসপত্র নিয়ে বৈঠা বাইয়ে লোকজন ছুটছে দিগি¦দিক। দূরে কোথাও কোন স্কুল ঘর চোখে পড়লে সেখানেই আশ্রয়। ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বড় অংশই দখল। সামান্য যা খালি ছিল বন্যার আগেই তা দখল হয়েছে। এর মধ্যেই পরিচয়ের সূত্র ধরে কেউ ঝুপরি তুলে থাকার অনুমতি দেয়। এ জন্য অবশ্য ‘নজরানা’ দরকার। তাও দেয়। বাঁধের ওপর জায়গা না মিললে ভিনগাঁয়ে। সেখানেও সহজে মেলে না। ডুবে থাকা ঘরবাড়ি কবে জেগে উঠবে তার খোঁজখবর নেয়। পাউবো জানায়, সারিয়াকান্দিও যে এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তা শক্ত কাঠামো, হার্ডপয়েন্ট রিভেটমেন্টের ভেতরে পূর্বদিকে। পানি বেড়ে যাওয়া ও পানি কমে যাওয়া এই দুই সময়েই ভাঙ্গনের মাত্রা বেড়ে যায়। যমুনার পশ্চিম তীর রক্ষা করা গেছে। গত দশ বছরে ভাঙ্গন রোধে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাউবো বাঁধ রক্ষা ও ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। মাটির বাঁধে সিপেজ (পানি চুয়ে পড়া) শুরু হলে নতুন বাঁধের এস্টিমেট করে। এগুলো রুটিন কাজ। বন্যার মতো বন্যা আসে। পাউবো তার মতো কাজ করে। বন্যার পর ক্ষণিক পরবাসী মানুষ ফিরে যায় নিজঘরে। ততদিনে বন্যা ধ্বংসের চিহ্ন রেখে যা করার তাই করে। নতুন করে ঘর মেরামত। ঘর গোছানো। জমির আবাদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। যমুনা যে চরগ্রাম কেড়ে নিয়েছে সেই মানুষের জীবন গানের কথার মতো ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা। চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বললেন, এবারের বন্যার ধরন আলাদা। প্রায় এক মাস আগে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। তখন কেউ গা করেনি। পানি বেড়ে যাওয়ার সময় বন্যার চেঁচামেচি। মানুষ তো বুঝতেই পারছিল বড় বন্যা আসছে। এখন যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বগুড়ায় যমুনা ও বাঙালী তীরের সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৯ টি ইউনিয়নের ১৫৮টি গ্রাম বন্যায় ভেসে আছে। চারটি চরগ্রাম ভাঙ্গনের থাবায় যমুনাগর্ভে। প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ জলবন্দী। ১০ হাজার হেক্টর জমির পাট, আউশ, বীজতলা ও সবচি পানির নিচে।
×