ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৩ জন রিমাণ্ডে

সাহাবুদ্দীন ॥ প্রতারণা থেকে রেহাই পাননি বিদেশীরাও

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২২ জুলাই ২০২০

সাহাবুদ্দীন ॥ প্রতারণা থেকে রেহাই পাননি বিদেশীরাও

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ সাহাবুদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাননি বিদেশী নাগরিকরা। করোনা আক্রান্ত না হওয়ার পরও এক রাশিয়ান নাগরিককে পজিটিভ দেখানো হয়েছে। ভর্তি ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এদিকে অনুমোদন ছাড়া করোনা পরীক্ষা ও ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা এবং জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতারকৃত সাহাবুদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মালিকের ছেলে ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়সাল আল ইসলামসহ (৩৪) তিনজনের পাঁচদিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অপর দুজন হচ্ছে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ মোঃ আবুল হাসনাত (৫২) এবং ইনভেন্টরি অফিসার শাহরিজ কবির সাদির (৩৩)। র‌্যাব জানায়, কৌশলে রোগী ভর্তি রেখে অতিরিক্ত বিল বাণিজ্যও করছিল হাসপাতালটি। পাশাপাশি রোগীদের বিল বাড়াতে একই টেস্ট বারবার করাচ্ছিল। এই জালিয়াতি ঢাকতে হাসপাতালটি বিলের ডাটা পর্যন্ত ডিলিট করে দেয়া হয়েছে। র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জনকণ্ঠকে জানান, হাসপাতালের নথিপত্রে দেখা যায়, প্রকৌশলী পাবলভ (৫০) নামে রাশিয়ার এক নাগরিককে করোনা নেগেটিভ হলেও তাকে কেবিনে রেখে করোনার চিকিৎসা দিয়েছে সাহাবুদ্দীন হাসপাতাল। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রকৌশলী পাবলভ প্রথমে করোনা পরীক্ষার জন্য গুলশান সাহাবুদ্দীন হাসপাতালে যান। সেখানে পরীক্ষা করে তাকে জানানো হয় তার করোনা পজিটিভ। পরে ওই রাশিয়ার নাগরিক ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করান। সেখানে তাকে করোনা নেগেটিভ দেখা হয়। নেগেটিভ হওয়ার পরও তাকে সাহাবুদ্দীনের কেবিনে রেখে চিকিৎসা দিয়ে সাতদিনে প্রায় সাত লাখ টাকা বিল করে। ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, এই হাসপাতালের আইসিইউতে করোনা পজিটিভ তিন রোগীর মধ্যে একজন নেগেটিভ রোগীকে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। গত ২৫ জুন রেহেনা আক্তার নামের এক রোগীর কাছ থেকে একদিনে ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা আদায় করেছেন গ্রেফতারকৃত সাহাবুদ্দীনের এমডি ফয়সাল, সহকারী পরিচালক ডাঃ আবুল হাসনাত ও শাহরিজ কবির সাদি। গত ২৪ জুন মোঃ আবদুস সাত্তার নামে এক রোগী ভর্তি হন এই হাসপাতালে। সেখানে তাকে কোভিড-১৯ পজিটিভ ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে ভর্তি রাখা হয়েছিল। এরপর একদিনে বিভিন্ন টেস্ট, ওষুধসহ তার হাসপাতাল বিল করা হয় এক লাখ ২৩ হাজার টাকা। কিন্তু পরদিন ওই রোগী ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করালে রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। এভাবেই সাহাবুদ্দীন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। গত ১৪ জুন রাজধানীর নিকুঞ্জের বাসিন্দা এনামুল হক তার মাকে কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য সাহাবুদ্দীন হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর ধরা পড়ে টাকার বিনিময়ে তার মায়ের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এনামুল র‌্যাবকে জানায়, মায়ের করোনা পরীক্ষার জন্য তিন হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে একটি মানিরিসিট দেয়। নমুনা নেয়ার পর ওইদিন বিকেলে হাসপাতালে ফোন করে জিজ্ঞেস করি রিপোর্ট কখন পাব। তখন হাসপাতাল থেকে বলা হয়, কোন রিপোর্ট দেয়া হবে না। আমি অন্য কোন হাসপাতালে ভর্তি করতে গেলেও তো এই রিপোর্টের দরকার। তখন হাসপাতাল বলে মায়ের করোনা নেগেটিভ। তাই রিপোর্ট দেয়া হবে না। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ই-মেইলে অভিযোগ দিলে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এ রকম আরও ১৭ জন রোগীর কাছ থেকে এভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণপত্র রয়েছে র‌্যাবের হাতে। সারওয়ার আলম জানান, অতিরিক্ত বিল নৈরাজ্য এবং টেস্ট বাণিজ্য বন্ধে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি জানান, এই বাণিজ্য যারাই করছেন দ্রুত বন্ধ করুন। নয়তো এসব অপরাধীকে কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে। এমন প্রতারণার অভিযোগে হাসপাতালের মালিকসহ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতর বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হবে। মামলায় যারা আসামি হবেন তাদের গ্রেফতারের মাধ্যমে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে। র‌্যাব জানায়, অভিযানে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেশকিছু বিলের ডকুমেন্ট হাতে পেয়েছে। অতিরিক্ত বিল বাণিজ্যে অনেক তথ্য হাসপাতালের এ্যাকাউন্ট বা বিল বিভাগের কম্পিউটার থেকে ডিলিট করে দিয়েছে। চলতি বছরের জুনের কান ডাটাই হাসপাতালের সার্ভারে নেই। অভিযানের আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমস্ত ডাটা ডিলিট করে ফেলেছে। এজাহার নামীয় আসামির নির্দেশে এই কাজটি করেছেন বলে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এই হাসপাতাল রোগী ভর্তি রেখে অতিরিক্ত বিল বাণিজ্য করছিল। এছাড়া রোগীদের বিল বাড়াতে একই টেস্ট দুই থেকে তিনবার দেখানো হতো। কোভিড-১৯ নেগেটিভ রোগীদের ভুয়া পজিটিভ রিপোর্ট দিয়ে তাদেরও ভর্তি করা হতো। পাশাপাশি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত নানা টেস্ট দেখিয়ে তাদের আইসিইউ ও কেবিনে রেখে বানানো হতো মোটা অঙ্কের বিল। র‌্যাবের সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, হাসপাতালটির জুন মাসের সমস্ত বিলের ডাটা ডিলিট করে দিয়েছে। এছাড়া সহকারী পরিচালক ডাঃ মোঃ আবুল হাসনাতের তথ্যমতে নয়টি র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ধার করা হয়েছে। আরও কিট ছিল, সেগুলো তারা সরিয়ে ফেলেছে। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ মোঃ আবুল হাসনাত নিজে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টগুলোতে স্বাক্ষর করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সাহাবুদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দীনের নামে এই হাসপাতালের নামকরণ করা হয়। এক সময় তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের সহসভাপতি ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাহাবুদ্দীন জানান, যা ঘটেছে এর কিছুই তিনি জানতেন না। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও চিকিৎসায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়ী করে তিনি জানান, এজন্য তাদের সাজা পেতে হবে। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটি যেন বন্ধ না করে দেয়া হয়। এটি বন্ধ করে দেয়া হলে মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। গ্রেফতারকৃত হাসপাতালের এমডি ফয়সালসহ তিনজন রিমান্ডে ॥ অনুমোদন ছাড়া করোনা পরীক্ষা ও ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা এবং জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতারকৃত সাহাবুদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়সাল আল ইসলামসহ (৩৪) তিনজনের পাঁচদিন করে রিমান্ড নিয়েছে পুলিশ। অপর দু’জন হচ্ছে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ মোঃ আবুল হাসনাত এবং ইনভেন্টরি অফিসার শাহরিজ কবির সাদির।
×