ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহাপ্রতারক সাহেদের আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২২ জুলাই ২০২০

মহাপ্রতারক সাহেদের আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন

আজাদ সুলায়মান ॥ রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডেও মহাপ্রতারক সাহেদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তার ঘনিষ্ঠজনদের অন্তত চারজন চিহ্নিত অপরাধী বলে পুলিশ জানিয়েছে। বিশেষ করে, গুলশান ও উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে অপরাধ জগতের ত্রাসদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। মঙ্গলবার সাহেদের প্রতারণা মামলার তদন্তভার র‌্যাবকে দেয়া হয়েছে। ডিবির কাছে থেকে তাকে আজ (বুধবার) র‌্যাবে হস্তান্তর করা হতে পারে। এই প্রতারকের বিরুদ্ধে সোমবার রাতে উত্তরা থানায় প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের দায়ে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া একটি বেসরকারী ব্যাংকের দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, সাহেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেশ কিছু নাম পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে গুলশানের ইন্ডিয়ান বাবু ও সারোয়ার হোসেন অপু তার অন্যতম সহযোগী। এমনকি একাধিক মামলার আসামি ইন্ডিয়ান বাবুকে সাহেদের দৈনিক পত্রিকা নতুন কাগজের নির্বাহী সম্পাদক পর্যন্ত বানিয়েছে। প্রতারণার টাকা দিয়ে ওই পত্রিকায় কয়েকজন গণ্যমান্য সাংবাদিককে নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু র‌্যাবের জালে ধরা পড়ার পর তার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সন্ত্রাসীদের নিয়ে সে প্রায়ই নানা অপকর্মে যেত। মিডিয়াকে ব্যবহার করে লোকজনকে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। ডিবির হেফাজতে থাকা সাহেদও এসব কথা অকপটে স্বীকার করেছে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্রটি বলছে, সাহেদ তার অনেক আশ্রয়তাদার নাম বলেছে। তার দেয়া তথ্যেগুলো যাচাই-বাছাই করে এ্যাকশনে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। রিজেন্ট হাসপাতালের সাবেক কর্মকর্তা বলেন, সাহেদের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেক সন্ত্রাসীর যোগাযোগ আছে। গুলশানের ইন্ডিয়ান বাবু, নাসির আহমেদ ও সারোয়ার হোসেন অপু অন্যতম। তাদের মধ্যে বাবু ও নাসির এক সময় বিএনপির রাজনীতি করত। তাদের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমাম হোসেনের সম্পর্ক আছে। তারা পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। বাবু নতুন কাগজের নির্বাহী সম্পাদক। পত্রিকা অফিসটি আগে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে ছিল। ২০১৫ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা করলেও থাকত আন্ডারগ্রাউন্ডে। নাসির, বাবু ও অপুর কাছে নিয়মিত থাকত ওয়াকিটকি। বাবু ও নাসিরের মাধ্যমে বনানী এলাকায় রিজেন্টের একটি অফিস নিয়েছিল সাহেদ। ওই অফিসে ছিল মাফিয়াদের আনাগোনা। সেখানে মারজিয়া আক্তার মুমু নামে এক তরুণী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এই প্রসঙ্গে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম বলেছেন, সাহেদের পলাতক সহযোগীদের ধরতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। সাহেদ ইন্টারন্যাশনাল বাটপার। মানুষের ক্ষতি ছাড়া তার কোন কাজ ছিল না। অনেক ব্যবসায়ীর টাকা মেরে দিয়েছে সাহেদ। বিভিন্ন মান্যগণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে ওইসব ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধমকি দিত। অভিযোগের পর অভিযোগ আসছে। অপরাধীর সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হবে। পুলিশ জানিয়েছে, এই প্রতারকের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করেছেন এক ভুক্তভোগী। প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন মেট্রো রেল নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত একটি সাব-কন্ট্রাক্ট প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ৭৬ জন শ্রমিক ও কর্মচারীর করোনা পরীক্ষা করানো হয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে। মঙ্গলবার ডিএমপির উত্তরা পশ্চিম থানার এস আই নাজমুল হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে ‘মেট্রো রেল নির্মাণের কাজ করছে এমন একটি সাব-কন্ট্রাক্ট প্রতিষ্ঠান মামলা করছে। মোঃ রেজাউল করীম নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে সোমবার রাতে মামলাটি করেছেন। মামলা নম্বর ২০। তিনি মামলায় অভিযোগ করেছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে ৭৬ জন শ্রমিকের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়েছে। যা ভুয়া ছিল। পরীক্ষার কথা বলে রিজেন্ট হাসপাতাল টাকা আত্মসাত করেছে। এ সম্পর্কে মামলার বাদী রেজাউল করিম জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের হয়ে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্য থেকে ৭৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছিল রিজেন্ট। এখন তারা শুনছেন, সব জালিয়াতি করা হয়েছে। তাই তিনি মামলা করেছেন। এদিকে মোহাম্মদ সাহেদের প্রতারণার মামলার তদন্তভার র‌্যাবকে দেয়া হয়েছে। এতদিন মামলার তদন্ত করছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মঙ্গলবার সাহেদ করিমের মামলার তদন্ত করার জন্য র‌্যাবকে দায়িত্বভার দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। র‌্যাব জানিয়েছে, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর র‌্যাব বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমসহ ১৭ জনকে আসামি করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলার তদন্তভার র‌্যাবকে দেয়া হয়েছে। র‌্যাবের দায়ের করা মামলাটি উত্তরা পশ্চিম থানা এবং পরে অধিকতর তদন্তের জন্য ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার তদন্তভার র‌্যাবকে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ডিবিতে ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছে সাহেদ, তার ক’জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। গত ৬ দিনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও ডিবি কাক্সিক্ষত তথ্য আদায় করতে পারেনি। বিশেষ করে সরকারী ও রাষ্ট্রীয় দিবসগুলোতে রাজকীয় প্রটোকল নিয়ে তার প্রবেশাধিকারের রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়নি। সাহেদ এখন পর্যন্ত শুধু রিজেন্ট হাসপাতালে করোনার নকল সনদ জালিয়াতি ছাড়া আর তেমন কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। জানা গেছে, রিমান্ডে সাহেদ, মাসুদ পারভেজ ও তারেক শিবলীকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা একজন আরেক জনকে দোষারোপ করলে নানা তথ্য দিয়ে চলেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এছাড়া সাহেদের প্রতারণা ছাড়াও দুর্নীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হাতে নিয়ে এখন মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এনআরবি ব্যাংকের এক কোটি ৫১ লাখ টাকা আত্মসাত করেছে বলে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় মামলা দায়ের করছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার কমিশনের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ইব্রাহিম খলিল, এনআরবি ব্যাংকের কর্পোরেট হেড অফিসের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার মোঃ সোহানুর রহমান ও ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদ বিন আহমেদ। পরিচালক জানান, তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এনআরবি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালের নবেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সুদসহ এক কোটি ৫১ লাখ ৮১ হাজার ৩৬৫ টাকা আত্মসাত করেছেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, শীঘ্রই দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ কমিশনের সহকারী পরিচালক মোঃ সিরাজুল হক বাদী হয়ে মামলাটি করবেন। উল্লেখ্য করোনাভাইরাসের পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট দেয়া, সরকারের কাছে বিল দেয়ার পর আবার রোগীর কাছ থেকেও অর্থ নেয়াসহ নানা অনিয়মের খবর পেয়ে র‌্যাব গত ৭ ও ৮ জুলাই অভিযান চালিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরা শাখা বন্ধ করে দেয়। হাসপাতালটির লাইসেন্সের মেয়াদও ছিল না। পরে ওই হাসপাতালের অনুমোদন বাতিল করে স্বাস্থ্য বিভাগ। পরে পালিয়ে থাকার পর বোরকা গায়ে নারী সেজে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত এলাকার একটি নৌকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।
×