ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তৃতীয় দফায় আরও নতুন জেলায় বিস্তার লাভ করতে পারে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ২৮ লাখ মানুষ পানিবন্দী

বন্যা ভয়াবহ রূপে

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২২ জুলাই ২০২০

বন্যা ভয়াবহ রূপে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইতোমধ্যে দেশে বন্যার স্থায়িত্ব ২৭ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে উজানে ঢল এবং দেশের ভেতরে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তৃতীয় দফায় বন্যার প্রকোপ শুরু হয়েছে। এই দফার বন্যার স্থায়িত্ব আরও ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে। ফলে এবার সহজে বন্যার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশবাসী। উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা দীর্ঘদিন ধরেই বন্যার কবলে রয়েছে। নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি আরও নতুন জেলায় বিস্তার লাভ করতে পারে বলেও তারা জানায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, তৃতীয় দফায় বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। এ বছর গত ২৬ জুন দেশ প্রথমবারের মতো বন্যার প্রকোপে পড়ে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে পানি কমতে শুরু করে। কিন্তু দু’দিন পানি কমতে না কমতেই দ্বিতীয় দফার বন্যার প্রকোপ শুরু। গত ১৭ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় বন্যার পানি কমতে থাকে। কিন্তু এ দফায় দুদিন কমতে না কমতেই আবারও নদ-নদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বন্যার পানিতে রাজধানীর চারপাশ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক নি¤œাঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে সব নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখন নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশের সব নদ-নদীর পানি বেড়ে যাবে। এমনকি এই দফায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী অববাহিকার নদীগুলোর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা সৃষ্টির আভাস রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে আগের ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৭২টি স্টেশনের। কমেছে ২৫টি স্টেশনে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৭টি স্টেশনে। তারা জানায়, গত দুই দিন ধরে উজানে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নতুন করে বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় এবং সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ায় সিলেট অঞ্চলে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এবারের বন্যার পানি আগামী আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এরপর পানি নেমে গেলে মানুষের দুর্ভোগ থাকবে আরও কিছুদিন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, তৃতীয় দফার এ ঢলে বন্যা পরিস্থিতি আগের চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। এ ঢলের সঙ্গে দেশে বৃষ্টিও বেশি হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ দফায় ২০ থেকে ২৫টি জেলা বন্যাকবলিত হতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় ২৮ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। বন্যার কারণে বাড়িঘর ও ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৬ লাখ মানুষ। এদিকে রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর পানি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় নি¤œাঞ্চল প্লাবিত। এই অবস্থায় আরও ৪৮ ঘণ্টা পানি বাড়ার আভাস রয়েছে রাজধানীর চার নদীর। ঢাকার নিম্নাঞ্চলে ডুবে গেছে সড়ক টানা বৃষ্টি এবং বন্যার পানির ঢলে রাজধানী খিলগাঁওয়ের নাসিরাবাদ এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দুদিন আগেও যেসব সড়কে পানি ছিল না, ওই সব সড়ক পানির নিচে। এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, দেশের বেশিরভাগ এলাকায় মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে। উত্তরাঞ্চলসহ কয়েকটি এলাকায় অতি ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির পাশাপাশি পানিবন্দী মানুষের কষ্ট বাড়বে। আমাদের স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর: মানিকগঞ্জ ॥ পদ্মা-যমুনার পানি বিপদসীমার ৬৩ সেন্টউপর দয়ে প্রবাহচ্ছে অভ্যন্তরীণ কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও ইছামতী নদীর পাবৃদ্ধি পাচ্ছে। শিবালয়, ঘিওর, দৌলতপুর, হরিরামপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবস্থা বেশি খারাপ। সাটুরিয়া ও সদর উপজেলাসহ জেলা শহরের আশপাশে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চরাঞ্চলে কোরবানির পশু নিয়ে বানভাসি মানুষজন কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিন যাপন করছেন। মাদারীপুর ॥ পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদে পানি বৃদ্ধি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানিবন্দী হাজার হাজার পরিবার। পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদের পানি বৃদ্ধি ও তীব্র ¯্রােত অব্যাহত থাকায় নদী ভাঙ্গন প্রকট আকার ধারণ করেছে। জেলার শিবচরের ৭ ইউনিয়নে প্রায় ২০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। শরীয়তপুর ॥ বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম শরীয়তপুর-মাওয়া সড়ক বিভিন্ন অংশ ইতোমধ্যেই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আসন্ন ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে ভোগান্তি চরমে পৌঁছবে। এছাড়াও বন্যায় শরীয়তপুর সদরসহ নড়িয়া, জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার প্রায় গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষ। নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা ডুবে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে নদ-নদীগুলোর সামান্য পানি কমলেও ধরলা নদীর পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার অববাহিকার রৌমারী, রাজিবপুর, চিলমারী, উলিপুর, কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ী উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নের ৪শ’ ৫টি চর-দ্বীপ চরে ৫শ’ ৩৮টি গ্রামে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। চরাঞ্চলে বিশেষ করে দুর্গম চর ও দ্বীপচরগুলোর মানুষজনের ঘরে এখনও এক কোমর, এক গলা পানি থাকায় ছোট ছোট নৌকায় বসবাস করছে এসব এলাকার মানুষজন। প্রায় তিন সপ্তাহ এভাবে বসবাস করায় খাদ্য সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠছে। গাইবান্ধা ॥ ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়াসহ সব নদীর পানি ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে। বন্যার ফলে যেসব পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে তারা এখনও ঘরে ফিরে যেতে পারেনি। খাদ্য ও কর্মের অভাবে গরু-ছাগল নিয়ে চরম-দুর্দশার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। অপরদিকে বন্যার পানি কমতে থাকায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ১১টি পয়েন্টে নদী ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। নাটোর ॥ কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাত ও আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেঃমিঃ উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে নাটোরের সিংড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দী পরিবারের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে শুরু করেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সিংড়া পৌর শহরের ৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে শতাধিক পরিবারের লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। টাঙ্গাইল ॥ ধনবাড়ী উপজেলার বৈরান নদীর মুশুদ্দি কসাইবাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও মুশুদ্দি বাজারসংলগ্ন গাইডওয়াল ভেঙ্গে ১৫ গ্রাম প্লাবিত। এতে চলতি আমন মৌসুমের বীজতলা ও শত শত একর সবজি ফসল, মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বিভিন্ন গ্রামের কয়েক শ’ পরিবার। নীলফামারী ॥ চার দফা ঢলের বন্যার রেশ কাটিয়ে উঠতে উঠতে মঙ্গলবার সকাল হতে তিস্তা নদীতে পঞ্চম দফার উজানের ঢলে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার প্রায় ৮ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত। সোনারগাঁ ॥ ভারি বর্ষণের ফলে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। অধিকাংশ রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, বাঁশের সাঁকো ও বাড়ির আঙিনা পানিতে তলিয়ে গেছে। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পানিবন্দী মানুষগুলো চরম ভোগান্তিতে বসবাস করছেন।
×