ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেবার নামে হরিলুট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২০ জুলাই ২০২০

সেবার নামে হরিলুট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে

ফিরোজ মান্না ॥ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার নামে চলছে হরিলুট। সেবা না দিয়েই মাস শেষে বিল নিয়ে যাচ্ছে। পাড়া-মহল্লার মস্তানদের হাতে ব্রডব্যান্ড ব্যবসা থাকায় গ্রাহকরা সেবা না পেলেও কিছু বলতে পারেন না। এদের কারণে প্রকৃত ব্রডব্যান্ড সেবাদাতারা কোন এলাকায় সংযোগ দিতে পারছেন না। লাইসেন্সধারী আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডর) অনেক এলাকায় ইন্টারনেট সার্ভিস দিতে গিয়ে অবৈধ আইএসপিদের হাতে ইতোমধ্যেই লাঞ্ছিত হওয়ার মতো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য তারা কোন পাড়া-মহল্লায় ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছেন না। অবৈধ আইএসপিরাই পাড়া- মহল্লায় ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। ১০ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড) ব্যান্ডউইথ দেয়ার কথা বলে সংযোগ দিয়ে ২ থেকে ৩ এমবিপিএস সরবরাহ দিচ্ছে। যা দিয়ে কোন কাজই করা যায় না। বর্তমানে অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস চলছে। ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় ছাত্রছাত্রীরা ভালভাবে ক্লাসও করতে পারছে না। ব্যবসা বাণিজ্যের কাজও বন্ধ থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়। বিষয়টি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে এখনও ব্রডব্যান্ড গড়ে উঠেনি। সর্বনিম্ন ইন্টারনেটের গতি থাকতে হবে ১০ এমবিপিএস। এর নিচে ৯ এমবিপিএস হলেও ব্রডব্যান্ড হিসাবে গণ্য হবে না। পাড়া-মহল্লার অবৈধ আইএসপি যারা চালান-তারা মূলত ওই এলাকার প্রভাবশালী। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বলতে যা বুঝায় এখন পর্যন্ত এটা প্রতিষ্ঠা পায়নি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রকৃত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা গ্রাহক পর্যায়ে দিতে। সূত্র জানিয়েছে, বিটিসিএল প্রকৃত ব্রডব্যান্ড লাইসেন্সধারীদের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করার কথা। কিন্তু তারা অবৈধ আইএসপিদের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করছে। তারা এক জিবি ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কিনে দেড় শ’ থেকে ২শ’ গ্রাহককে দিচ্ছে। ফলে ব্যান্ডউইথের পরিমাণ অনেক কমে যাচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে তখন আর ১০ এমবিপিএস আসছে না। আসে ৪ থেকে ৫ এমবিপিএস। করোনা মহামারীতে পাড়া-মহল্লার আইএসপিরা নির্দিষ্ট ব্যান্ডউইথের মধ্যে আরও অধিক সংযোগ দিয়েছে। ফলে এখন ব্রডব্যান্ডের অবস্থা খুবই খারাপ। নামেই শুধু ব্রডব্যান্ড সংযোগ। কখনও কখনও ৪ থেকে ৫ এমবিপিএসও গতি থাকে না। নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। পাড়া-মহল্লার মস্তানের নিয়নের ব্রডব্যান্ড ছাড়া বিকল্প লাইন নেয়ার কোন সুযোগ নেই। কেউ যদি বড় কোন আইএসপি থেকে সংযোগ নেন তাহলে ওই গ্রাহককে হেনস্থার শিকার হতে হয়। যদি গ্রাহককে হেনস্থা না করে তাহলে ইন্টারনেট ক্যাবল কেটে দিয়ে যায়। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে এমন এক অরাজকতা চলছে। কোথাও কোন অভিযোগ দেয়ার জায়গা নেই। বিটিসিএলয়ে অভিযোগ দিয়ে কোন লাভ নেই। কারণ বিটিসিএল’র অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী অবৈধ আইএসপিদের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করছেন। অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে তারাও অনেকে কোটিপতি হয়ে গেছেন। এটা যেন আরেক ভিওআইপি। বিটিসিএল’র নতুন ব্যবসার দ্বার খুলেছে। এখান থেকে বড় অঙ্কের টাকার ওপর হলেও যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছেও অভিযোগ করার কোন জায়গা রাখা হয়নি। অনেক সময় পুলিশও পাড়া- মহল্লার আইএসপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। কারণ বিষয়টি ‘টেকনিক্যাল’। ফলে পুলিশ তাদের বিষয়ে কোন অভিযোগ নেয় না। তারাই ডিস ও ইন্টারনেট ব্যবসা কব্জা করেছে। প্রকৃত আইএসপিরা পাড়া-মহল্লায় ঢুকতে পারেন না। এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েই কোন লাভ হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট আমরা গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু শহরে গ্রাহকরা যে ভোগান্তি পোহাচ্ছে সেটাই দূর করা যাচ্ছে না। সরকারীভাবে বিটিসিএল ইন্টারনেট সরবরাহ করা হয় গ্রাহক পর্যায়ে। বিটিসিএল’র ইন্টারনেটের গতি অনেক বেশি। আইএসপিবির সভাপতি আমিনুল হাকিম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকৃত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়ার জন্য বৈধ আইএসপির সংখ্য ২ হাজার। এর বাইরে আইএসপির আরও ৭শ’ সদস্য রয়েছে। মূলত সারাদেশে ২ হাজার ৭শ’ আইএসপি বৈধভাবে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবেন। এর বাইরে যারা সেবা দিচ্ছে তাদের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এদের কোন লাইসেন্স নেই। এক সময় ডিস লাইনের ব্যবসা করত। যখন ব্রডব্যান্ড সংযোগ শুরু হলো তখন তারাই এই ব্যবসাটি নিয়ে নিলো। আমরা আর পাড়া-মহল্লায় ঢুকতে পারলাম না। ফলে গ্রাহক প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করেছি বেশকিছু এলাকায় ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়ার জন্য। কিন্তু সম্ভব হয়নি পাড়া-মহল্লার মস্তানদের কারণে। কারণ তারা আমাদের ক্যাবল কেটে নিয়ে যায়। আবার কোথাও কোথাও আমাদের লোকজনদের লাঞ্ছিতও করেছে। ফলে মস্তানদের সঙ্গে মস্তানি করা আমাদের কাজ না। আমরা ভালভাবে ব্যবসা করতে চাই কারও সঙ্গে বিবাধ করে ব্যবসা করার মানসিকতা আমাদের নেই। আমিনুল হাকিম বলেন, করোনা মহামারীতে ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অফিস, আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুই চলছে। সারাদেশেই চলছে সরকারী-বেসরকারী অফিসে ‘জুম মিটিং’ জুমে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বেশি প্রয়োজন হয়। তাই গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কম পাচ্ছে। তাছাড়া পাড়া- মহল্লা অবৈধ ব্যবসায়ীরা অল্প পরিমাণ ব্যান্ডউইথ নিয়ে বেশি সংযোগ দেয়ার কারণে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমার বাসায় আগে ১০ এমবিপিএস’র লাইন ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে আমাকে ব্যান্ডউইথের ভলিউম বাড়াতে হয়েছে। আমি এখন ৫০ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ নিয়েও মেকাপ দিতে পারছি না। কারণ আমাকে বাসা থেকেই অফিস করতে হচ্ছে। আমার দুই মেয়ে স্কুলের ক্লাস করছে। আমার স্ত্রী শিক্ষক। তিনিও অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। সরকারের উচিত ছিল ব্যান্ডউইথের পরিমাণ বাড়িয়ে দাম কমিয়ে দেয়া। এছাড়া করোনাকালের জন্য স্পেক্টার্ম বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া। তাহলে সব সমস্যার সমাধান হতো। ঢাকা ছেড়ে প্রায় ৭০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী এখন গ্রামের বাড়ি রয়েছে। তারা আবার ঢাকায় ফিরে এলে ব্যান্ডউইথের অবস্থা তখন আরও খারাপ হবে। কারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টারনেট সব সময়ের জন্য প্রয়োজন। গ্রাহকদের প্রকৃত ব্যান্ডউইথ সুবিধা দেয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ইন্টারনেট এখন মানুষের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে চলে গেছে। এখানে অবৈধ আইএসপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখনই সময়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশই সম্ভবত সেই দেশ, যেখানে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার নাম করে মানুষের পরিশ্রমের টাকা সবচেয়ে বেশি ‘ডাকাতি’ করে নেয়া হচ্ছে। এটা যেমন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বেলায় ঠিক তেমনি বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলোর বেলায়ও একই অবস্থা। দেশের মানুষ দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ১৬ কোটি দেশের মানুষের মধ্যে ১১ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এই সুযোগে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেটের চড়া দাম নিচ্ছে। মানুষও অসহায়ের মতো ঠিকঠাক সেবাটা ব্যবহারও করছে। কারও কিছু বলার থাকছে না। যারা বলবেন, তারা কোন স্বার্থে কিছু বলেন না তা বোঝা মুশকিল। ফাইবার অপটিক ক্যাবল দিয়ে যেটা ব্যবহার করি, সেটাকে সহজ ভাষায় আমরা বলি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। ব্রডব্যান্ড বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায় না। অধিকাংশ উপজেলা শহরেই ব্রডব্যান্ড নেই।
×