শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দীন। যুক্তরাজ্যে পলাতক আল বদর নেতা মঈনুদ্দীনকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল। মঈনুদ্দীনকে কেন যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- এ কারণে তার মানহানি হয়েছে এবং মানহানি হওয়ার কারণে ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে মামলা করেছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদন্ড সাজা মাথায় নিয়ে যুক্তরাজ্যে পলাতক আল বদর নেতা মঈনুদ্দীনের এই ধরনের কান্ডে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, আবারও আলোচনায় ঘাতক মঈনুদ্দীন চৌধুরী।
আল বদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায়ে মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার সঙ্গী অপর যুদ্ধাপরাধী যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আশরাফুজ্জামান খানকেও একই অপরাধে একই মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় ২০১৩ সালে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীলনক্সা বাস্তবায়নকারী আল বদর নেতাকে স্বাধীনতার পর দেশে আসার সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি তার নিরাপত্তা দেয়ায় সাবেক দুই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদকে ধিক্কার জানিয়েছে আদালত। মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড সাজা হওয়ার পর তাদেরকে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ফাঁসির দন্ড পাওয়া প্রবাসী দুই যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু বিগত ৭ বছর পরও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মঈনুদ্দীন চৌধুরীসহ দুই যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হয়নি। উপরন্তু ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে আবারও আলোচনায় এসেছে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আল বদর নেতা মঈনুদ্দীন।
বুদ্ধিজীবীদের এই ঘাতক মঈনুদ্দীনকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়ে টুইট করায় ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের বিরুদ্ধে ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে গত মাসে হাইকোর্টে মামলা করেন বলে ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টুইটার এ্যাকাউন্টে কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের ‘চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম’ বিষয়ক নথি শেয়ার করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধসহ মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধের জন্য তাকে দায়ী করে মানহানি করা হয়েছে বলে মঈনুদ্দীনের দাবি। এই যুদ্ধাপরাধীর মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওই নথিটি প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ের টুইট থেকে প্রকাশ করা হয়। পরে সেটা ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল, বিবিসির সাংবাদিক মিশাল হুসেইন, মানবাধিকার কর্মী পিটার ট্যাটচেলসহ অনেকেই রিটুইট করেছেন। চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম বিষয়ক ওই প্রতিবেদনে ইউরোপীয় ডেটা সংরক্ষণ বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং অবৈধভাবে তার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে রিট মামলায় দাবি করেছেন মঈনুদ্দীন। গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন গত ২০ মার্চ পর্যন্ত কমিশনের ওয়েবসাইটে ছিল। মঈনুদ্দীনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে অস্বীকারও করেছিল কমিশন। তবে পরে এই যুদ্ধাপরাধীর সম্পর্কিত সব তথ্য মুছে ফেলা হয়। বিষয়টিকে বিচারাধীন হিসেবে বর্ণনা করে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখপাত্র।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয় দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে। জামায়াতে ইসলামী তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পলাতক এই দুই কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে পলাতক মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। আশরাফুজ্জামান ও মঈনুদ্দীন ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কিভাবে আল বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন তা রায়ে উঠে এসেছে।
পলাতক এই দুই বদর নেতা বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াননি। আত্মসমর্পণ না করায় তারা আপীলের সুযোগ হারালেও এখন পর্যন্ত তাদেরকে ফিরিয়ে এনে দন্ড কার্যকর করা যায়নি। একাত্তরে বাঙালী জাতিকে মেধা শূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজার রায়ের পর সাত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পলাতক এই যুদ্ধাপরাধীকে দেশে ফেরানো যায়। যুক্তরাজ্য মৃত্যুদন্ডকে সমর্থন করে না বলে মঈনুদ্দীন সেখানে বহাল তবিয়তে আছে। আর আশরাফুজ্জামানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনও কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকার ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করে যাচ্ছে বরাবরই দাবি করা হচ্ছে।
জিয়া-এরশাদকে আদালতের ধিক্কার ॥ একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীলনক্সা বাস্তবায়নকারী আল বদর নেতাকে স্বাধীনতার পর দেশে আসার সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি তার নিরাপত্তা দেয়ায় সাবেক দুই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদকে ধিক্কার জানিয়েছে আদালত। স্বাধীনতার পর পালিয়ে যাওয়া মঈনুদ্দীন পরে জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে দেশে এসেছিল। আদালত রায়ে বলা হয়েছে, এটা জাতির বড় একটি লজ্জা যে জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে দিয়েছে। তাদের পুলিশী নিরাপত্তাও দেয়া হয়েছে। আদালত বলেছে, হোয়াট এ শেইম, হোয়াট এ শেইম। সন্দেহাতীতভাবে এটা দেশের জাতিকে নাড়া দিয়েছে এবং হেয় প্রতিপন্ন করেছে, যা নিপীড়নের শিকার পরিবারের ক্ষতকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় মেশিনারি দিয়ে সম্মান দেয়া হলো। মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে। তার অনুপস্থিতিতে বিচার শেষে রায় হয়।
আশরাফ-মঈনুদ্দীনকে ফেরত পাঠাতে আহ্বান জয়ের ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদন্ড সাজা হওয়ার পর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিজের ফেসবুক পৃষ্ঠায় জয় লেখেন, আদালতের রায়ে কুখ্যাত আল বদর খুনী মঈন ও আশরাফ দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড পেয়েছেন। অবিশ্বাস্য হলেও মঈন যুক্তরাজ্যে স্থানীয় কমিউনিটির নেতা এবং আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় কমিউনিটির নেতা। আমি দুই রাষ্ট্রকেই অবিলম্বে তাদের দন্ডদানার্থে হস্তান্তরের দাবি জানাই।
মঈন-আশরাফকে ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে- কাদের ॥ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে ফাঁসির দন্ড পাওয়া প্রবাসী দুই যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনতে সরকার ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করছে। ২০১৬ সালে বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেছিলেন সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী কাদের।
কে এই মঈনুদ্দিন চৌধুরী ॥ চৌধুরী মঈনুদ্দীনের জন্ম ১৯৪৮ সালের নবেম্বরে, ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে মঈনুদ্দীন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছে। মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মঈনুদ্দীন ছিল জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের একজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্য। সেই হিসেবে পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আল বদর বাহিনীতেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষ ভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিল সে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যায়। সেখান থেকে যায় যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত লন্ডনেই অবস্থান করছে। লন্ডনে জামায়াতের সংগঠন দাওয়াতুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক দাওয়াতের বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছে।