ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বড় নাশকতার ছক ॥ ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক সক্রিয়

প্রকাশিত: ২২:৩০, ২০ জুলাই ২০২০

বড় নাশকতার ছক ॥ ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক সক্রিয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করেছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। গ্রেফতার এড়িয়ে জঙ্গী তৎপরতা চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে নারী জঙ্গীদের। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবি ছয় বছর ধরে এজন্য কাজ করছে। পুরুষ জঙ্গীদের পাশাপাশি চলছে নারী জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ। নারী জঙ্গীদের সমন্বয়ে গঠিত আত্মঘাতী স্কোয়াড দিয়ে দেশে বড় ধরনের নাশকতা ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সম্প্রতি এক নারী জঙ্গী গ্রেফতার হওয়ার পর তদন্তে এমন ভয়াবহ তথ্য বের হয়ে এসেছে। তদন্ত সূত্র জানায়, সর্বশেষ সদরঘাট থেকে এক নারী জঙ্গী গ্রেফতার হওয়ার পর পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ওই নারী জঙ্গী একসঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতীয় নাগরিক বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তাকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। সর্বশেষ গ্রেফতারকৃতকে নিয়ে গত চার বছরে গ্রেফতারকৃত ৩৭ জন নারী জঙ্গীর মধ্যে ৩৩ জনই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এরমধ্যে ২৪ জন আত্মঘাতী মানসিকতা পোষণ করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার প্রকৌশলী ওয়ালিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গত ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে আয়েশা জান্নাত মোহনা ওরফে জান্নাতুত তাসনিম ওরফে প্রজ্ঞা দেবনাথ (২৫) নামের যে নারী জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে সে নব্য জেএমবির (জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) নারী শাখার অন্যতম সদস্য। তার কাছে ভারতীয় পাসপোর্ট, বাংলাদেশের একটি জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট, একটি বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র ও জঙ্গীবাদের আলামত সমৃদ্ধ দুটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ এই নারীকে গ্রেফতার করেছে। সূত্র বলছে, এই নারী একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক। সে আরও কোন দেশের নাগরিকও হতে পারে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এই নারী কি উদ্দেশে বাংলাদেশে এসেছে তা স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সে জঙ্গী তৎপরতা শক্তিশালী করতেই এখানে এসেছে। আবার ভারতে সে মোস্টওয়ান্টেড হয়েও এদেশে পালিয়ে আসতে পারে। এ ব্যাপারে ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। পাশাপাশি তার বাংলাদেশী জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট সঠিক কিনা তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশে পুরুষ জঙ্গীদের তৎপরতা থাকার বিষয়টি আগাগোড়াই জানা ছিল। নারী জঙ্গীদের তৎপরতা পুরুষ জঙ্গীদের চেয়েও কোন কোন ক্ষেত্রে যে আরও বেশি তা জানা যায় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণে জেএমবি জঙ্গী শাকিল আহাম্মদ ওরফে শাকিল গাজী ও সোবাহান মন্ডল ওরফে সোবাহান শেখ নিহত হয়। ওই বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয় শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও সোবাহান শেখের স্ত্রী আলিমা বিবি। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে রীতিমত পিলে চমকানোর মতো তথ্য দেয়। পরবর্তীতে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সে তথ্য আদান প্রদান হয়। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক দুই নারী জঙ্গী জানায়, শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জঙ্গীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় জেএমবি জঙ্গীরা ভারতে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। সেই আস্তানায় তৈরি করা শত শত শক্তিশালী গ্রেনেড স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে থাকা জঙ্গীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরবরাহ করা গ্রেনেড দিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতিও চলছে। জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ সূত্র বলছে, এমন তথ্যের সত্যতা মিলে পাকিস্তান থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরার পর তাদের হাতে জেএমবির কারাবন্দী আমীর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের ছোট মেয়ের জামাই সাখাওয়াতুল কবির গ্রেফতার হওয়ার পর। তাকে দেশে জঙ্গী তৎপরতা চালানোর দায়ে ২০১৪ সালের ১৮ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। সূত্রটি জানায়, মহাখালী সরকারী তিতুমীর কলেজে পড়ার সময় ইজাজ ওরফে কারগিলের মাধ্যমে তার জেএমবি আমীর মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের সঙ্গে পরিচয় হয়। ইজাজ তিতুমীর কলেজের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র ছিল। ইজাজ মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের বড় মেয়েকে বিয়ে করে। ইজাজের মাধ্যমে সাখাওয়াতুল কবির জেএমবি আমীর সাইদুর রহমানের ছোট মেয়েকে বিয়ে করে। পরে ইজাজ ও সাখাওয়াতুল কবির দু’জনেই জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাকিস্তানে চলে যায়। সাখাওয়াতুল কবির দেশে ফিরে জঙ্গী কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকে। আর ইজাজ পাকিস্তানেই থেকে যায়। সূত্রটি বলছে, ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পেশোয়ারের সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুলে ৬ জঙ্গী সশস্ত্র বোমা হামলা ও গুলি চালায়। এক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে ক্লাসের ভেতরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করে। এ দৃশ্য দেখতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে জঙ্গীরা। শিক্ষক মারা যাওয়ার পর ক্লাসে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী ১৪২ জন শিক্ষার্থী আর ৮ জন শিক্ষককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে জঙ্গীরা। এমন ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানে জঙ্গী ঘাঁটিতে সাঁড়াশি অভিযান চলতে থাকে। ধারাবাহিক অভিযানে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের জেএমবির আমীর সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই ইজাজ ওরফে কারগিলসহ ৪ বাংলাদেশী জঙ্গী মারা যায়। ইজাজের স্ত্রী এখনও পাকিস্তানেই রয়েছে। সে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নিহত অপর তিন বাংলাদেশী জঙ্গী হচ্ছে, জেএমবির আমীর সাইদুর রহমানের আরেক মেয়ের জামাই পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসার পর গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী সাখাওয়াতুল কবিরের ভাগ্নি জামাই অভি, পাকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশী নারী জঙ্গী ফাতেমার স্বামী সায়েম ও সায়েমের বোন জামাই শামীম। সাখাওয়াতুল কবিরের ভাগ্নি, নিহত সায়েমের স্ত্রী ফাতেমা ও সায়েমের বোন এখনও পাকিস্তানেই রয়েছে। চার জন মারা যাওয়ার পর তারা আর দেশে ফেরেননি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান করে তারা অপারেশন ও প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে। তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছে। নিহত ইজাজ ওরফে কারগিলের প্রত্যক্ষ মদদ আর আর্থিক সহায়তা ও বুদ্ধি পরামর্শে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জন্ম হয়। আর্মিদের স্কুলে হামলার ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর জড়িত থাকা চার জঙ্গী আব্দুস সালাম, হজরত আলী, মুজিবুর রেহমান ও সাবিল ওরফে ইয়াহিয়ার ফাঁসি কার্যকর করা হয় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কোহাতে অবস্থিত একটি কারাগারে। হামলার দায় স্বীকার করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। সংগঠনটির দাবি, উত্তর ওয়াজিরস্তানে তালেবানের ঘাঁটি জার্ব-ই-আজবে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ হিসেবে হামলাটি চালানো হয়েছিল। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, পাকিস্তানে থাকা নারী জঙ্গীদের সঙ্গে ভারতে গ্রেফতার হওয়া দুই নারী জঙ্গী এবং বাংলাদেশে সর্বশেষ প্রজ্ঞা দেবনাথসহ ৩৭ জন নারী জঙ্গী গ্রেফতার হলো। যার মধ্যে প্রথম সারির অন্তত ১০ নারীর সঙ্গে দেশ-বিদেশের বহু জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ২০১৬ সাল থেকেই বাংলাদেশে নারী জঙ্গীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলে আসছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার মগবাজারে ও গাজীপুরে সাঁড়াশি অভিযান চালালে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় আত্মঘাতী নব্য জেএমবির নারী জঙ্গী স্কোয়াডের সদস্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশি (২৩), জামায়াতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমি ওরফে মৌ (২২), খাদিজা পারভীন ওরফে মেঘলা (২৩) ও আকলিমা রহমান ওরফে মনি (২৩)। গ্রেফতারকৃতরা সাফিয়া ওরফে সানজিদা ওরফে ঝিনুক, মাইমুনা ওরফে মাহমুদা ওরফে লায়লা, তাসনুবা ওরফে তাহিরা, সায়লা ওরফে শাহিদা, সালেহা ওরফে পুতুল, দিনাত জাহান ওরফে নওমী ওরফে বাণী, তানজিলা ওরফে মুন্নী, আলিয়া ওরফে তিন্নি ওরফে তিতলী, মনিরা জাহান ওরফে মিলি ও ছাবিহা ওরফে মিতু নামের দশ নারী জঙ্গীর তথ্য দেয়। ডাঃ ঐশী ২০১৩ সালে জঙ্গীবাদে জড়ায়। সে মাসিক ১২ হাজার টাকা করে চাঁদা দিত। নারী জঙ্গীরা অনেককেই জঙ্গী প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও পাঠায় বলে তথ্য দেয়। সেই তথ্য মোতাবেক ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটের একটি হোটেল থেকে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাকিস্তান যাওয়ার প্রস্তুতিকালে দুই জোড়া নবদম্পতি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, মারজিয়া আক্তার ওরফে সুমি (১৯), স্বামী মোঃ শরিফুল ইসলাম ওরফে সুলতান মাহমুদ তাপস ওরফে মাহমুদ (১৮)। মোঃ আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিনুল (৩৪) ও তার স্ত্রী নাহিদ সুলতানা (৩০)। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে আত্মঘাতী নারী জঙ্গী হুমায়রা গ্রেফতার হয়। ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়া নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য সাইফুল ইসলামকে আত্মঘাতী হামলা চালাতে প্ররোচনাসহ যাবতীয় খবর বহন করেছিল গ্রেফতারকৃত নারী জঙ্গী হুমায়রা। ওইদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের অনুষ্ঠানে আত্মঘাতী হামলা করে আওয়ামী লীগের অন্তত শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। হুমায়রা ওরফে নাবিলার স্বামী তানভীর ইয়াসির করিমও নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িত। ২০১৭ সালের ১৯ নবেম্বর গ্রেফতার হয়। হুমায়রা নব্য জেএমবির সিস্টার্স উইং বা নারী শাখার দায়িত্বশীল পদে রয়েছে। হুমায়রা রাজধানীর একটি বিলাসবহুল শপিং মলের মালিকের মেয়ে। ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করে। পরে মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে। তার স্বামী তানভীরও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তানভীরের সঙ্গে পরিচয়। স্বামীর হাত ধরে সেও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার ছোট গদাইরচর গাঙপাড় এলাকার নিলুফা ভিলা ও একই জেলার সদর উপজেলার শেখেরচরের দীঘিরপাড়ের বিল্লালের বাড়িটির জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। শেখেরচরের আস্তানায় আত্মঘাতী হয়ে নিহত হন আত্মঘাতী জঙ্গী দম্পতি আকলিমা আক্তার মনি ও তার স্বামী আবু আব্দুল্লাহ বাঙালী। আকলিমা ইতোপূর্বে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। আর নিলুফা ভিলার আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয় খাদিজা আক্তার মেঘলা ওরফে মেঘনা ও মৌ নামের দুই নারী জঙ্গী। এরাও ইতোপূর্বে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হামলা চালানোর সঙ্গে পরিস্থিতি অনুযায়ী নারী বা পুরুষ আত্মঘাতী জঙ্গীদের অংশ নিতে জঙ্গী সংগঠনগুলো তাদের সদস্য নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। এজন্য নারী জঙ্গীদের আরও প্রশিক্ষিত করতে বিদেশ পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এখনও বাংলাদেশ থেকে যুবক ও যুবতীদের পাকিস্তান, সিরিয়া ও ইরাক পাঠানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। যেটি খুবই আশ্চর্যজনক। কারণ যেখানে আইএসের ঘাঁটি শেষ হওয়ার পথে, সেখানে এখনও জঙ্গীবাদের বীজ বপন করতে চায় দেশী-বিদেশী জঙ্গী সংগঠনগুলো। বিদেশে থাকা নব্য জেএমবির সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশী জঙ্গীদের যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকেও এদেশীয় জঙ্গীরা অর্থ সহায়তা পেয়ে আসছে। গত বছরের ৯ জুলাই বরিশাল থেকে আনসার আল ইসলাম জঙ্গী জান্নাতুল নাঈমা (২২) ও তার সহযোগী আফজাল হোসেন (২৩) র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। তাদের হেফাজত থেকে গত বছরের ২৬ জুন চট্টগ্রাম থেকে নিখোঁজ হওয়া সাফিয়া আক্তার তানজীকে (২২) উদ্ধার করা হয়। তানজীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল গ্রেফতারকৃত দুই জঙ্গী। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত নারী ও পুরুষ জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। নারী ও পুরুষ জঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে জঙ্গীবাদের কর্মকান্ড চালায় বলে স্বীকার করেছে। ২০১৬ সাল থেকে নারী জঙ্গীরা গ্রেফতার হওয়া শুরু হলেও, মূলত নারী জঙ্গীদের নানাভাবে দলে ভেড়ানো হচ্ছে ২০১৩ সাল থেকেই। জেএমবি যেসব জঙ্গীদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে, তাদের দিয়ে জেএমবি নারী সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠন করে দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে চায়। আর আনসার আল ইসলামের টার্গেট ভিন্ন। তারা নারী জঙ্গীদের দলে ভিড়িয়ে তাদের দিয়েও জেএমবির মতো আত্মঘাতী স্কোয়াড গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দুইটি জঙ্গী সংগঠনের টার্গেটের ভিন্নতা আছে। জেএমবি চায় ওভারঅল দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে। আর আনসার আল ইসলাম রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট করে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা করতে চায়। এজন্য তারা নারী জঙ্গীদের দিয়ে সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠনে বেশী তৎপরতা চালাচ্ছে। বিষয়টি সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে আছে। সে মোতাবেক ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। সম্প্রতি নারী জঙ্গীসহ পুরুষ জঙ্গীদের তৎপরতা বাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোঃ কামরুল আহসান ও ইউনিটটির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তারা জানান, তারা ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছেন। অভিযানে নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আল্লাহর দলের অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। চলতি বছর চালানো অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে অন্তত ১১ জন। যারা সবাই আত্মস্বীকৃত জঙ্গী। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যুবক, যুবতী, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাও আছে। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা জঙ্গীবাদের পেছনে মদদ যোগানোর পাশাপাশি অর্থ সহায়তাও করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের করপোরেট শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, তার স্ত্রী ও সন্তানরা। তারা পল্লবীর নিজ বাড়িতেই জঙ্গী আস্তানা গড়ে তুলেছিল।
×