ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানিকারক ‘স্টক লট’ উল্লেখ করে পণ্য আমদানি করেন যা পুরোপুরি নিষিদ্ধ

৪ বছর আগে বাজেয়াফত মেমোরি কার্ড ছাড় করতে চায় ঢাকা কাস্টমস

প্রকাশিত: ২১:১৫, ২০ জুলাই ২০২০

৪ বছর আগে বাজেয়াফত মেমোরি কার্ড ছাড় করতে চায় ঢাকা কাস্টমস

রহিম শেখ ॥ আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী ‘স্টক লট’ উল্লেখ করে কোন পণ্য আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তারপরও এমন ঘোষণা দিয়ে ২০১৬ সালে ২ লাখ ১০ হাজার মেমোরি কার্ড আমদানি করেন এক ব্যবসায়ী। চোরাচালান সন্দেহে ওই বছরের ১১ জুন নিষিদ্ধ ঘোষিত ওই পণ্য আটক করে ঢাকা কাস্টম হাউস। ১ মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত করা সেই মেমোরি কার্ড আবার ছাড় করতে চাইছে ঢাকা কাস্টম হাউস। সম্প্রতি কাস্টম হাউস ঢাকার কমিশনার এই পণ্য চালান খালাসে ৯ পাতার একটি বিচারাদেশও দিয়েছে। এদিকে আমদানি নিষিদ্ধ এই পণ্য চুরি হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি এনবিআরে আবেদন করে ৪০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন সেই ব্যবসায়ী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, চোরাচালান সন্দেহে ২০১৬ সালের ১১ জুন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা ২ লাখ ১০ হাজার মেমরি কার্ডের একটি চালান আটক করেন। আটক প্রতিবেদনে চালানটির বাজার মূল্য ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়। ব্যাগেজ রুলস বহির্ভূত নিষিদ্ধ পণ্য বহনের জন্য এই মেমোরি কার্ডের মালিক মামুন হাওলাদারকে শোকজ করা হয়। তার দেয়া ইনভয়েসে স্টক লট পণ্য উল্লেখ রয়েছে। ‘স্টক লট’ পণ্য উল্লেখ করা সেই ব্যবসায়ীর ইনভয়েসের কপি রয়েছে জনকণ্ঠের কাছে। যা আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ এ আমদানি নিষিদ্ধ বলা রয়েছে। এই কারণে তৎকালীন কমিশনার মোঃ লুৎফুর রহমান এই ব্যবসায়ীকে শোকজ করেন। পরে বিচারাদেশ দেয়ার সময় এই মেমোরি কার্ডের কোন বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ওই ব্যবসায়ী এই পণ্যের মালিকানা দাবি করবেন না বলে ঢাকা কাস্টমস হাউসে লিখিত দেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া সিপিতেও বলা হয়েছে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য বাদে অন্য পণ্য খালাস করা যাবে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিপির বিষয়টি উল্লেখ না করে বর্তমান ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন ব্যবসায়ী ইনভয়েসে স্টক লট উল্লেখ না থাকার পরও বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে শুল্ককর পরিশোধে খালাসযোগ্য বলে ৯ পাতার একটি বিচারাদেশ দেন। রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত হওয়া পণ্য ৪ বছর পরে এসে বর্তমান কমিশনার গত ১ মার্চ বিচারাদেশে ৫ লাখ টাকা জরিমানাসহ মোট ৩১ লাখ ৭০ হাজার ৬৭৭ টাকা পরিশোধ করে পণ্য খালাসের আদেশ দেন। যদিও আগের কমিশনার কর্তৃক আটক প্রতিবেদনে পণ্যটি আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এর ১৫৬ ধারায় ব্যবস্থা নেন এবং এই মেমোরি কার্ড বাজেয়াফত করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, মেমোরি কার্ড আমদানি নিষিদ্ধ কোন পণ্য না। ব্যাগেজ রুলস বহির্ভূতভাবে এই পণ্য নিয়ে আসায় সাময়িকভাবে বাজেয়াফত করা হয়েছিল। এই পণ্য চালান স্টক লট বা আমদানি নিষিদ্ধ কোন পণ্য নয় বলেও দাবি করেন তিনি। আমদানি নীতিতে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকার খ অংশের ৪ নম্বরে বলা হয়েছে, স্টক লট পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ। যাত্রীর দেয়া ইনভয়েসেও স্টক লটপণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাগেজ রুলস বহির্তূত এই পণ্য বহনে কাস্টমস আইনে লঙ্গন করায় পণ্য আটক করা হয়েছিল যা কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এর ১৫৬ ধারায় শাস্থিযোগ্য অপরাধ বলে আটক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এই পণ্য পরিবহনে দি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট (কন্ট্রোল) এক্ট ১৯৫০ এর সেকশন থ্রি এবং আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ লঙ্ঘন বলে বলা হয়েছে আটক প্রতিবেদনে। সূত্র জানায়, ১১ জুন ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিমানের বিজি ০৮৯ ফ্লাইটে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে আসা মামুন হাওলাদারের পণ্য আটক করা হয় ঢাকা বিমানবন্দরের কাস্টমসের আগমনী হলের ব্যাগেজ কাউন্টার থেকে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আটক করা হয় এসব পণ্য। আটক প্রতিবেদনে বলা হয়, মেমোরি কার্ড বহনের ক্ষেত্রে কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এর ২ (এস), সেকশন ১৬, সেকশন ৩২ ধারা লঙ্ঘন, দি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট (কন্ট্রোল) এ্যাক্ট ১৯৫০ এর সেকশন থ্রি, আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এর ১৫৬ ধারায় ২ লাখ ১০ হাজার মেমোরি কার্ড আটক করা হয়। এর ভ্যালু নির্ধারণ করা হয় ৬ কোটি ৩২ লাখ ৩১ হাজার ৬শ’ টাকা। ঘটনা এখানেই শেষ নয় এর আগে এই পণ্য প্রাইভেট অফারে নিলামের সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ইলেক্ট্রন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় পণ্য নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ অগ্রিম হিসেবে ৫টি পে-অডারের মাধ্যমে ঢাকা কাস্টমসের অনুকূলে ৮৬ লাখ টাকাও জমা করে। কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানকে নিলামে দেয়া হয়নি। বর্তমান কমিশনারের আদেশে মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের পর্যালোচনা হিসেবে বলা হয়েছে, পণ্য ছাড়ের জন্য আইপি/সিপি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে মাননীয় আদালতের। আর সিপিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতীত শুল্ক কর পরিশোধ করে পণ্য খালাস করা যাবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই পণ্য চালান যিনি এনেছেন এবং যারা এর বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছেন সে বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা থেকে তদন্ত করে দেখা উচিত। সেইসঙ্গে অর্থপাচার হয়েছে কিনা তা তদন্ত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন আর অনেকক্ষেত্রে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজেশ থাকে। তাই বিষয়টি ভালভাবে খতিয়ে দেখা জরুরী। এনবিআর সূত্র আরও জানায়, রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত হওয়া স্টক লট অর্থাৎ আমদানি নিষিদ্ধ এই পণ্য চুরি হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি এনবিআরে আবেদন করেছে যাত্রী মামুন হাওলাদার। আর এনবিআরের কাছে ৪০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণও দাবি করছেন এই যাত্রী। পুরো ঘটনাকে আড়াল করতে এই অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে বলে মনে করেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী একজন যাত্রী কি পরিমাণে অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারেন তা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, ২০১৬ সালে একজন যাত্রী ৫ হাজার ডলারের বেশি দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই যাত্রী তার মেমোরি কার্ডের মূল্য ১০ কোটি টাকা দাবি করছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই যাত্রী কিভাবে এই পণ্যের দাম পরিশোধ করলেন। একজন সাধারণ যাত্রী ব্যাগেজ রুল বহির্ভূতভাবে কিভাবে ১০ কোটি টাকা দামের পণ্য নিয়ে আসলেন। যদিও তার জমা দেয়া ইনভয়েসে ১৮ হাজার ডলারের পণ্য বলে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে এনবিআরের একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এই পণ্য চালানে বড় ধরনের ঘাপলা আছে।
×