ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইনে জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত আয়েশা

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৯ জুলাই ২০২০

অনলাইনে জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত আয়েশা

শংকর কুমার দে ॥ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পঁচিশ বছর বয়সী প্রজ্ঞা দেবনাথ ধর্মান্তরিত হয়ে আয়েশা জান্নাত ওরফে জান্নাতুত তাসনিম পরিচয়ে ঢাকায় এসে জঙ্গী তৎপরতা চালাতে গিয়ে গ্রেফতার করার পর চারদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। ওমান প্রবাসী এক বাংলাদেশীর সঙ্গে বিয়ের পর এদেশে এসে জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে ভারতীয় এই নারী জঙ্গী। রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর মতিঝিল থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় শুক্রবার চারদিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ভারতীয় ওই নারী অনলাইনে জঙ্গী তৎপরতায় অংশ নিতে গিয়ে অনলাইনে ওমান প্রবাসী বাংলাদেশী আমির হোসেন সাদ্দামের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর টেলিফোনে দুজনের মধ্যে বিয়ে হয়- এমনটাই জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট-সিটিটিসি’র উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ধর্মান্তরিত এই নারী জঙ্গী আগে থেকে সে নব্য জেএমবির নারী শাখার সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ রাখত। সেখান থেকে সে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমান হয় এবং এক পর্যায়ে নব্য জেএমবির নারী শাখার প্রধান আসমানী খাতুনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। পঁচিশ বছর বয়সী ওই নারীর নাম আয়েশা জান্নাত মোহনা ওরফে জান্নাতুত তাসনিম। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে তার নাম ছিল প্রজ্ঞা দেবনাথ। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় তার বাড়ি। এই তরুণী একাধিকবার বৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছে। তার এই আসা-যাওয়ার কারণ কি ছিল তা জানার চেষ্টা হচ্ছে। সর্বশেষ গত অক্টোবরে স্বামী সাদ্দামের পরামর্শে তাসনিম বাংলাদেশে এসে আসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন বলে জানান সিটিটিসি’র কর্মকর্তা। তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি’র সূত্রে জানা গেছে, এই নারী জঙ্গী বাংলাদেশে আসার পর সে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট তৈরি করে তা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। তা দিয়ে নব্য জেএমবির সদস্যদের সহায়তায় ঢাকার কেরানীগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বিভিন্ন মাদ্রাসায় চাকরি নেয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর কমলাপুর এলাকা থেকে আসমানী খাতুন ওরফে আসমা ওরফে আমাতুল্লাহ সিটিটিসির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২৮ বছরের এই নারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় রিমান্ড শেষে তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। ওই মামলাতেই ধর্মান্তরিত ভারতীয় এই তরুণীকেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে আসমানী গ্রেফতার হওয়ার পর ধর্মান্তরিত ভারতীয় এই নারী চাকরি ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যায় এবং গোপনে নব্য জেএমবির নারী সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচপত্র ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি’র কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদে ধর্মান্তরিত ওই ভারতীয় নারী জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাসনিম অনলাইনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরপর ধর্মান্তরিত হয়ে অনলাইনে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে। সেখান থেকে নব্য জেএমবির সদস্যরা তাকে দলে ভেড়ান। এরপর থেকে আসমানীর পরামর্শে সে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তার আরও বেশ কিছু সহযোগী আছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে সিটিটিসি’র কর্মকর্তার দাবি। ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার সকালে কাগজে ছবি দেখে প্রজ্ঞা দেবনাথের পরিবারের সবাই চিনতে পারেন তাকে, আইএস ভাবধারায় গড়ে ওঠা নব্য জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গীগোষ্ঠীর মহিলা ব্রিগেডের নেত্রী আয়েশা জন্নত মোহনাই প্রকৃতপক্ষে হুগলির ধনিয়াখালির কেশবপুর গ্রামের প্রজ্ঞা দেবনাথ। বৃহস্পতিবার তাকে ঢাকা থেকে পাকড়াও করে বাংলাদেশের পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট-সিটিটিসি। প্রজ্ঞার মা গীতা দেবনাথ বলেছেন, পড়াশোনায় খারাপ ছিল না মেয়ে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে ভালই রেজাল্ট করেছিল। সংস্কৃত নিয়ে ভর্তি হয়েছিল ধনিয়াখালি কলেজে। তবে পড়া শেষ করার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় প্রজ্ঞা। বাবা প্রদীপ দেবনাথ দিনমজুরের কাজ করেন। মা গীতা বাড়িতেই সেলাই করে ফেরি করেন জামাকাপড়। দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। তার মধ্যেই ছেলে এবং মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্রজ্ঞার বাবা প্রদীপ-মা গীতা। গীতা দেবনাথ বলেছেন, দিনটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় কলকাতা যাবে বলে বেরোয় মেয়ে। তারপর থেকে লাপাত্তা। বেশ কয়েকদিন পর ফোন আসে অচেনা নম্বর থেকে। মাকে মেয়ে জানায়, সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। বিয়েও করেছে সেই ধর্মের এক ছেলেকে। তারপর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু মেয়ে যে জঙ্গী দলে নাম লিখিয়েছে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশীরাও। বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি’র জিজ্ঞাসাবাদে প্রজ্ঞা বলেছেন, নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ২০০৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অনলাইনে জিহাদিরা প্রজ্ঞাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে বলে দাবি করেছেন। কিন্তু প্রজ্ঞার বাবা প্রদীপ ও মা গীতার দাবি, ঢাকার পুলিশের কাছে ২০০৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে সেটা ঠিক না। সে সময় মেয়ের কোন পরিবর্তন তাদের চোখে পড়েনি। তবে কলেজে যাওয়ার পর থেকে যে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মেয়ে জড়িয়ে পড়েছিল তা তারা স্বীকার করেন। এলাকার বাসিন্দারাও বলেন, প্রজ্ঞা কলেজে পড়ার সময় থেকেই বাইরের লোকজন আসা-যাওয়া শুরু করে ওদের বাড়িতে। তারপর আমরা প্রতিবাদ করলে বাইরের লোকের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়। প্রজ্ঞার মা গীতা বলেছেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে বেকার। ছেলে একটা বেসরকারী নিরাপত্তা সংস্থায় চাকরি করত। কিন্তু সেই চাকরিও লকডাউনের সময় চলে গিয়েছে। তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে নব্য জেএমবির মহিলা শাখার প্রধান আসমানি খাতুন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই সংগঠনের মহিলা শাখা বকলমে চালাচ্ছিল প্রজ্ঞা। জঙ্গী সংগঠনে তার নাম ছিল আয়েশা জন্নত মোহনা এবং জন্নাতুল তসমিন। অনলাইনে নতুন সদস্য নিয়োগ করা থেকে শুরু করে ‘দাওয়াত’ বা নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাতো প্রজ্ঞা। ওমানে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়া এক বাংলাদেশী নাগরিককে ফোনে ‘নিকাহ’ করে সে। তার স্বামীও নব্য জেএমবি সংগঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অনথিভুক্ত মাদ্রাসায় শিক্ষিকার কাজ করত প্রজ্ঞা। সেখান থেকেই চলত প্রশিক্ষণের কাজও। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগঠনের জন্য টাকা সংগ্রহ করা এবং বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে সেই টাকা খরচ করা। ২০১৬ সালে যখন ফোন করে প্রজ্ঞা ইসলাম ধর্ম নেয়ার কথা বলে, সেই সময় সে জানিয়েছিল যে বাংলাদেশে রয়েছে। আইএস এবং সম মনোভাবাপন্ন সংগঠনগুলোর নিয়োগ রোখা বা নজরদারি থাকা সত্ত্বেও একটি মেয়ে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে চলে গেল এবং ইসলাম ধর্ম নিল সেই বিষয়ে তদন্ত করে দেখছে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। ভারতের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী প্রজ্ঞার ঘটনা প্রমাণ করছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তেই জমি তৈরি করছে এই ধরনের জঙ্গী সংগঠন। বাড়ি থেকে পালিয়ে সেই সংগঠনে যোগ দিচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ভারতে প্রজ্ঞাই প্রথম কোন মহিলা যে ধর্ম পরিবর্তন করে আইএস মদদপুষ্ট সংগঠনে যোগ দিয়েছে। আর এই প্রবণতা যে যথেষ্ট চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাগণ। তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ধর্মান্তরিত এই নারী জেএমবি’র (জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) নারী শাখার অন্যতম সদস্য। তার কাছে পাওয়া ভারতীয় পাসপোর্টের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
×