ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১৯ জুলাই ২০২০

নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে...। এই গানের বাণীর মতোই না থেকেও সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল তিনি। শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও বেঁচে আছেন আপন শিল্প ও সাহিত্যের ভুবনে। সরল রেখার মতোই সহজ লেখায় মোহাবিষ্ট করেছিলেন পাঠককে। একইসঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পকে ধারণ করে হেঁটেছেন বর্ণময় পথে। সমৃদ্ধ করেছেন এদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পকে। গল্প বা উপন্যাসের উদ্দীপক কিংবা রহস্যময় বুনটে বিভোর করে রেখেছিলেন পাঠককেই। বিচিত্র বিষয়ের নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প রসিককে দিয়েছেন নির্মল আনন্দ। এভাবেই ক্রমাগত সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জননন্দিত সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ ১৯ জুলাই বাংলা সাহিত্যের জননন্দিত এই লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকারের অষ্টম প্রয়াণবার্ষিকী। ২০১২ সালে এ দিন বর্ষার রাতে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাড়ি জমান অদেখার ভুবনে। পাঠক, ভক্ত, পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অশ্রুধারায় সিক্ত করে বিদায় জানান প্রিয় পৃথিবীকে। বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নাপ্রিয় এই সাহিত্য স্রষ্টার নিজ হাতে গড়া নন্দনকানন নুহাশপল্লীর লিচুতলায় শায়িত হন চিরনিদ্রায়। আজ লেখকের মৃত্যুদিবসে গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচুতলায় তার সমাধিতে নিবেদন করা হবে শ্রদ্ধাঞ্জলি। ভক্ত ও অনুরাগীরা শুভেচ্ছা ও দোয়া কামনার মাধ্যমে লেখকের প্রতি জানাবেন ভালবাসা। তবে মহামারীর কারণে এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এসেছে লেখকের জন্মদিন। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও আমরা পারিবারিকভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করব। আজ সকালে দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে হুমায়ূনের সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করব। এছাড়া কবর জিয়ারত করা হবে। তবে মহামারীর কারণে সীমিত পরিসরে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। হুমায়ূনের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবছর এতিমদের খাওয়ানো হবে। এবার সেখানকার এতিমখানাগুলো বন্ধ থাকায় সেই অর্থ দিয়ে করোনার কারণে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা হবে। গত এক মাস ধরে আমরা সেই তালিকা করেছি। এদিকে লেখকের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সমিতির রাজধানী শাখার সভাপতি এবং প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়েছেন। এছাড়া অন্যপ্রকাশের পক্ষ থেকে আজ রাত আটটায় হুমায়ূন আহমেদের তিন নায়ককে লাইভ আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে। লেখক ও নির্মাতার কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা করবেন রিয়াজ, ফেরদৌস ও মাহফুজ। অন্যপ্রকাশের ফেসবুক পেজে সরাসরি এই লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হবে। লেখকের মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন শনিবার একই পেজে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, কথাশিল্পী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, তহুরা আলী ও মেহের আফরোজ শাওন। লেখকের প্রয়াণবার্ষিকীতে আজ রবিবার প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্বসহকালে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। এছাড়া টিভি চ্যানেলগুলো নাটকসহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে জানাবে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। হুমায়ূন ভক্তদের গড়া হিমু পরিবহন নামের সংগঠনের পক্ষ থেকে লেখকের প্রয়াণবার্ষিকীতে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। ম্যাড থেটারের আয়োজনে রাত নয়টায় অনুষ্ঠিত হবে ‘ভালোবাসি হুমায়ূন’ শীর্ষক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান। পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। লিখেছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় গান। আর সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই নিজের পদচিহ্ন এঁকেছেন প্রত্যেকটিতেই দেখা পেয়েছেন সাফল্যের। বাংলা সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরই ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। উপন্যাসে ও নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তার লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তার নতুন লেখাটি ‘গোপনে’ পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তার অন্তত একটি নাটক বা চলচ্চিত্র দেখেনি কিংবা তার কোন বই পড়েনি। জনপ্রিয়তার জগতে এখনও তিনি একক ও অনন্য। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জš§গ্রহণ করেন। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি সবার বড়। খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তার ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীবও খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক। ১৯৮২ সালে যুক্তরাস্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী গ্রহণ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটুপুত্র কমলা। যেগুলো জয় করেছে দর্শক ও সমালোচকদের মন। টিভি নাট্যকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তার প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তার হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর চরিত্র বাকের ভাই যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে অর্জন করেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’। আরও পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পদক ও সম্মাননা। দেশের বাইরেও তাকে নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তার প্রমাণ জাপান টেলিভিশন ‘এনএইচকে’ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছে পনেরো মিনিটের তথ্যচিত্র ‘হু ইস হু ইন এশিয়া’। ১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ । হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এই পরিবারে জন্ম নেয় দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন। ২০১১ সালের সেপ্টেস্বর মাসে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে হুমায়ূন আহমেদের শরীরে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। সেখানে ২০১২ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখ তিনি চলে যান লাইফ সাপোর্টে। এর পরের ঘটনা শুধুই বেদনার। আজকের এই দিনে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যুতে পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্ক থেকে ২৩ জুলাই দেশে ফিরিয়ে আনা হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বিমানবন্দর থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। সেখানে লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত ফুলের ভালবাসায় সিক্ত হন তিনি। এর পরদিন তাকে সমাহিত করা হয় তার গড়ে তোলা নন্দনকানন নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়।
×