ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্কাইপ ও গুগল ক্লাস গফরগাঁওয়ে প্রথম

বাবুই- জুম ভার্র্চুয়াল লাইভে শিল্পের পাঠশালা

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ১৮ জুলাই ২০২০

বাবুই- জুম ভার্র্চুয়াল লাইভে শিল্পের পাঠশালা

সমুদ্র হক ॥ করোনার এই কঠিন ক্রান্তিলগ্নে বন্ধ হয়নি ছোট্টমণিদের শিল্পের পাঠশালা ‘বাবুই’। প্রজন্মের এই শিশুরা প্রমাণ করেছে, মনের গভীরে বেড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক চেতনাকে লকডাউনেও (ঘরবন্দী) বন্ধ রাখা যায় না। বাঙালীর সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে। এই ছোট্টমণিদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছর। জাতিসংঘের শিশু সংজ্ঞায় একেবারেই শিশু। বগুড়ার এই শিশুরা বড়দের অবাক করে দিয়ে ‘জুম’ সফটওয়্যারে একাউন্ট খুলে নিজেদের নিজস্ব লিংকে আইডি ও পাসওয়ার্ড যুক্ত করেছে। এরা নিজেদের বাড়িতে নির্দিষ্ট সময়ে প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। কোনদিন কে হোস্ট হবেন তা আগেই নির্ধারণ করা হয়। হোস্ট অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। তারপর লেখাপড়ার পাশাপশি সঙ্গীত, আবৃত্তি, নাচ, নাটক পরিবেশিত হয়। এভাবে বাবুইরা নিজেদের তৈরি করে। এরপর নির্দিষ্ট দিনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠশালায় এসে ভিডিও চিত্রধারণ করে। তারপর এডিটিং ও পুরো অনুষ্ঠান আপলোড করার জন্য সহযোগিতা নেয় বাবুইয়ের প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল হাসান জুয়েলের কাছে। জুয়েল জানালেন, এরা বাবুই পাখিদের মতোই। জানার অপার আগ্রহে কিচিরমিচির করে হৃদয় মাতিয়ে দেয়। এতই মেধাবী যে দু’য়েকদিন শিখিয়ে দেয়ার পর এরা নিজেরাই ঠিক করে নেয় কখন সে জুমে বসবে। এদের প্রত্যেকেই অভিভাবকের ল্যাপটপ ব্যবহার করে। অভিভাবক সঙ্গীত শিল্পী ফারজানা হুমায়ূন বললেন মেয়ের প্রবল আগ্রহ প্রযুক্তির জুম ব্যবহারে ঘরে বসেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ধরে রাখার যে ব্রত নিয়েছে তা দেখে তিনি মুগ্ধ। তার ল্যাপটপ মুক্ত করে দিয়েছেন মেয়ের জন্য। প্রজন্মের শিশুদের দৃঢ় মনোবল প্রমাণ করেছে আগামীর দেশ তারা নিরাপদ রাখবে। স্বল্প পরিসরে সেই প্রস্তুতির শুরু। বগুড়ায় শিশু কিশোরদের শিল্পের পাঠশালা বাবুইয়ের প্রতিষ্ঠাতা জুয়েল বললেন, শিশুদের ঘরে থাকতে বলেছেন। বাইরে বের হতে বারণ করেছেন। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাংস্কৃতির পরিমন্ডলে গড়ে তোলা এই শিশু শিক্ষার্থীরা ঘরে থেকে জুম সফটওয়্যারে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ধরে রাখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বিস্মিত হন। শিশুরা টিভিতে জুমে অংশগ্রহণের বিষয়টি দেখে ও জেনে এদের মধ্যে যে সৃষ্টিশীল ভাবনা এসেছে যা তাকে মুগ্ধ করে। নিজে একটি বেসরকারী টেলিভিশনের (ডিবিসি) রিপোর্টার হয়ে সামজিক দায়িত্ব পালনে এই ছোট্টমণিদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। জুয়েল প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা ও সদস্যদের কাছে গিয়ে শিশুদের আগ্রহের কথা বললে প্রত্যেকেই অভিভূত হয়ে ভার্চুয়ালে অংশগ্রহণের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ছোট্ট ছোট্ট জলের ফোঁটায় যেমন মহাসাগর তৈরি হয় তেমনই রূপক অর্থে ছোট্ট শিশুদের ছোট্ট ছোট্ট আগ্রহ বড় আকারের দিকে যায়। এই শিশুদের একটি ইচ্ছা শক্তি থেকে আরও সৃষ্টি শক্তির জন্ম নেয়। ওদের নিত্যদিনের সাংস্কৃতিক আড্ডা রিহার্সাল হয়ে ভিডিও চিত্রগ্রহণে এখন গুগল ইউটিউবে আপলোড হচ্ছে। কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুকে) বাবুই খুদে শিল্পীদের অনুষ্ঠান পোস্ট করছে। স্যাটেলাইটের কয়েকটি লিংক ছোটদের অনুষ্ঠান নিতে যোগাযোগ করছে। বাবুইয়ের সদস্য তিবাহ্, তরী, কথা ও গল্প। বলল খুব ভাল লাগছে। দুই বোন কথা ও গল্পের মা সঙ্গীত শিল্পী ফারজানা বললেন, মেয়েরা পরিচিতিজনের কাছে ঘরোয়া অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। যারা জুমে যুক্ত হতে পারেন না তাদের মোবাইল ফোনে শিখিয়ে দেয়। এভাবে দূরকে তার কাছে করছে। বাবুইয়ের পরিচালক জুয়েল বললেন তার প্রতিষ্ঠানে প্রথমেই পাঠ দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের। তারপর সঙ্গীত আবৃত্তি ছবি আঁকা শিশুদের নাটক। এদের সামাজিক ও পরিবেশ সচেতনায় গড়ে তোলা হয়। বাবুইয়ের শিশুরা করতোয়া নদী রক্ষায় প্রতীকী কাগজের নৌকা বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। শিশুদের এমন উদ্যোগ দেখে দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার আনন্দের অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। বললেন ‘একাত্তরে আমরা হানাদার পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। জীবনের প্রান্ত সীমায় আমরা আশাবাদী এই শিশুদের হাতে দেশ নিরাপদ থাকবে।’ গফরগাঁওয়ে এই প্রথম ॥ শেখ আব্দুল আওয়াল গফরগাঁও থেকে জানান, পৃথিবীতে এখন করোনা মহামারী ভাইরাসের কারণে বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নেই কোন ব্যবস্থা। বছরের প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হতে চললেও ছাত্রছাত্রীরা কবে ক্লাসে ফিরবেন তার নেই কোন নিশ্চয়তা। মহামারী করোনার কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। মহামারী বিপদের এই সময়ে মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন এতটাই উন্নত হয়েছে যে, হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব এখন আর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে না। শিক্ষার আদান-প্রদান এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এমন উদ্যোগ নিয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম। হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে ভার্চুয়াল ক্লাস শুরু হলেও এই জেলার ১৩ উপজেলায় ৪৬ শিক্ষক প্রায় প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ক্লাস নিচ্ছেন। জানা যায়, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হলো ভার্চুয়াল ক্লাসরুম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই প্রকল্পটি চালু হয়। এর মাধ্যমে দেশের সরকারী ৩২ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের মাধ্যমে এই কার্যক্রমে যুক্ত হয় বলে সূত্রে জানা যায়। এতে খরচ ও ভোগান্তি কমবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর। ক্লাসরুমে বসে আছে পড়ুয়ারা। কিন্তু শিক্ষকের আসন খালি। তিনি নেই, আবার আছেনও! এই ক্লাসে সশরীরে নেই, বরং শিক্ষক আসবেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এমন ভার্চুয়াল ক্লাসঘর বিদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরল নয়। তবে এবার এমনটা দেখা যায়, ময়মনসিংহ জেলার ১৩ উপজেলায়। এতে করে পিছিয়ে নেই বেসরকারী স্কুল, কলেজগুলো। চক, ব্ল্যাকবোর্ডের প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতির গন্ডি পেরিয়ে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে হাতেখড়ি হতে চলেছে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়েও। এ ব্যাপারে গফরগাঁও ইসলামিয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাজাহারুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। তিনি বলেন, আমি আইসিটির ব্যাপারে দেশে এবং বিদেশে কয়েকটি ট্রেনিং নিয়েছি। প্রথম আমার ধারণা গুগল ক্লাসরুম এরই ধারাবাহিকতায় গুগল ক্লাসরুম নিয়ে আলোচনা করে সেখান থেকে ৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে ভার্চুয়াল ক্লাস ইন্টারনেটের মাধ্যমে চালু করি। ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ২৬ মার্চ থেকে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে আমরা ভার্চুয়াল ক্লাসরুম পরিচালনার চিন্তা করি। আর এ চিন্তা থেকেই বর্তমানে ৪৬ শিক্ষককে নিয়ে ভার্চুয়াল ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে ১৩ উপজেলার প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী যুক্ত আছে। ভার্চুয়াল ক্লাসের প্রতি সব অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। ২১ জুন থেকে ময়মনসিংহ সদরের ৫টি ভালুকা, ধোবাউড়া, ত্রিশাল, ফুলপুর, গৌরিপুর ও গফরগাঁওসহ বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসরুম ও ভার্চুয়াল ক্লাশরুমে শিক্ষা নিচ্ছে। শুধু অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তরিকতা প্রয়োজন। খায়রুল্লাহ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাইশা মেহেজাবিন বলেন, অনলাইন, ভার্চুয়াল ক্লাস করে আমাদের অনেক ভাল লাগছে। ভার্চুয়াল ক্লাস ও অনলাইন থেকে আমরা যে শিক্ষা নিচ্ছি তা খুবই জরুরী ছিল। খায়রুল্লাহ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা (ভারপ্রাপ্ত) রহিমা খাতুন বলেন, ১৬ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পরপরই ২৬ মার্চ থেকে জেলা শিক্ষা অফিসারের নির্দেশে অনলাইন ফেসবুক লাইভ ক্লাস নেয়া শুরু করে আমাদের শিক্ষকরা। যা এখনও চলমান। শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ১৫ মে শুক্রবার দৈনিক জনকণ্ঠে করোনা কালে লেখাপড়া নিয়ে উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন, এদেশের লাখ লাখ ছেলেমেয়েদের এখন কোচিং নামের সেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাতে গিয়ে নিজেদের সৃজনশীলতাটুকু নষ্ট করতে হচ্ছে না। কে জানে হয়ত অনেক ছেলেমেয়ে নিজেদের পাঠ্যপুস্তক খুলে নিজেরা নিজেরা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করেছে সেটা মোটেও কঠিন কিছু না। করোনাকালের এই ঘরবন্দী দুঃসময়টি তাই হচ্ছে বই পড়ার সময়। সেইসব ছেলেমেয়েরা হচ্ছে সৌভাগ্যবান যাদের বাসাভর্তি বই, যারা বই পড়ে শেষ করতে পারছে না। অতীতেও পৃথিবী এ রকম বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে এসেছিল, এবারে কেন পারবে না।
×