ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুবাই পাচার তরুণীদের উদ্ধারে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হবে

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১৭ জুলাই ২০২০

দুবাই পাচার তরুণীদের উদ্ধারে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হবে

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে পাচার হওয়া তরুণী-কিশোরীদের উদ্ধারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনÑইন্টারপোলের সহায়তা নেবে পুলিশ। গত ১০ বছরে সহ¯্রাধিক তরুণী-কিশোরী পাচার হয়েছে দুবাইয়ে। গ্রেফতার করা হয়েছে পাচারকারী চক্রের হোতা আসামি আজম খান ও আলামিনকে। পাচারকারী চক্রের অন্যান্য সদস্য এখনও পলাতক। দুবাইয়ের বিলাসবহুল হোটেলে মোটা অঙ্কের টাকার চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে তাদের পাচার করেছে পাচারকারী চক্র। দুবাইয়ে পাচার করার পর তাদের দিয়ে নাচ, গান করানোর নামে পতিতাবৃত্তিতে জড়ানো হয়েছে। দুবাই থেকে ফিরে এসে বেশ কয়েক তরুণী; যার মধ্যে দুই তরুণী আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। পাচার হওয়া বেশিরভাগ তরুণী ও কিশোরী যারা ফিরে আসতে পারেনি তাদের উদ্ধারের জন্য ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগÑসিআইডি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, গত দশ বছরে বিশ-বাইশ বছর বয়সী হাজারের বেশি তরুণী-কিশোরীকে পাচার করা হয়েছে দুবাইয়ে। যাদের দুবাইয়ে বিলাসবহুল হোটেলে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল, তাদের অনেককেই জিম্মি করে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে জড়ানো হয়। দুবাইয়ে বাংলাদেশী এসব তরুণী-কিশোরীকে উদ্ধার করে পাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেবার কথা জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগেরÑসিআইডির এক কর্মকর্তা বলেছেন, আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান থেকেও মেয়েদের দুবাইয়ে পাচার করে পতিতাবৃত্তিতে জড়ায়। আমরা পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) মাধ্যমে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইব। সেজন্য আমরা ডকুমেন্ট তৈরি করছি। যদিও সময় একটু বেশি লাগছে। তবে আমরা সেখানে জিম্মি বাংলাদেশীদের উদ্ধার করব। সেজন্য ইন্টারপোলের সহায়তা দরকার। সম্প্রতি চক্রটির বাংলাদেশের হোতা আজম খানসহ তার দুই সহযোগী ময়না ও মোঃ আলামিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ডকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। ইতোমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন আজম খান ও তার সহযোগী ডায়মন্ড। সূত্রে জানা গেছে, সিআইডির হাতে গ্রেফতার আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের হোতা আজম খানের দেয়া জবানবন্দী, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দুবাইয়ের ফরচুন পার্ল হোটেল এ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্রান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ারের অন্যতম মালিক বাংলাদেশের চক্রটির গডফাদার আজম খান। অর্ধশত দালালের মাধ্যমে অল্পবয়সী মেয়েদের অথবা বিশ/বাইশ বছরের তরুণীদের উচ্চ বেতনে কাজ দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করতেন। বিশ্বস্ততার জন্য চাকরির আগেই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হতো। পাশাপাশি দুবাইয়ে যাওয়া-আসার সব খরচও দিত চক্রটি। দালালরা নির্ধারিত দুটি বিদেশী এয়ারলাইন্স এজেন্সির মাধ্যমে তাদের দুবাই পাঠাত। সেখানে যাওয়ার পরে প্রথমে তাদের ছোটখাটো কাজ দেয়া হতো। এর পর জোরপূর্বক ড্যান্সবারে নাচতে বাধ্য করা হতো। অন্যথায় শারীরিকভাবে নির্যাতন অথবা বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে বৈদ্যুতিক শক পর্যন্ত দেয়া হতো। দেয়া হতো না কোন খাবার। একপর্যায়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন অর্থাৎ পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো তাদের। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশী পাচারকারীদের গডফাদার আজম খান আদালতে সব স্বীকার করেছে। আমরা তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগও পেয়েছি, সেগুলোর অনুসন্ধান চলছে। তার বিরুদ্ধে সিআইডি শীঘ্রই মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করবে। পাচারকারী চক্রটি এক সঙ্গে ৪/৫ মেয়েকে দুবাইয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী মেয়ে এখনও সেখানে অবস্থান করছেন। তাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দূতাবাসের সহযোগিতায় ১৬ ভুক্তভোগী দেশে ফিরেছেন। গত ২ জুলাই সিআইডির এএসপি মৃণাল কান্তি সাহা বাদী হয়ে লালবাগ থানায় যে মামলা দায়ের করেছেন, সেখানে আজম খান এবং আরও আট জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় দুবাই থেকে ফেরা তিন তরুণীর নাম উল্লেখসহ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনাও করা হয়েছে। তরুণীরা জবানবন্দীতে বলেছেন, আজম খান এক তরুণীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পরে অন্য লোক দিয়েও ধর্ষণ করিয়েছে। কিন্তু এর বিনিময়ে তাকে কোন টাকা দেয়া হয়নি। দুই তরুণী আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে তারা বলেছেন, দুবাইয়ে নেয়ার পর তিন মাস ঘরে বসিয়েই খাওয়ানো হতো। টুকটাক কাজ কাউকে দিত, কাউকে দিত না। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেই আজম খানের আসল রূপ সামনে আসত। এরপর তরুণীদের নেয়া হতো নাইট ক্লাবে। কেউ যেতে রাজি না হলে তার ওপর চলত বর্বর নির্যাতন। হাত-পা কেটে দেয়া হতো, ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হতো। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তরুণীরা রাজি হতেন। তখন তরুণীদের আজম খান নিজেই ধর্ষণ করত। পরে পাঠানো হতো নাইট ক্লাবে। সেখানেই মনোরঞ্জন করতে হতো আগন্তুকদের। এ পর্যন্ত আজম খান দুবাইয়ে পাচার করেছেন ১ হাজারের বেশি নারীকে। দুই/এক জন ফিরে এলেও অধিকাংশই সেখানে রয়ে গেছেন। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, দুবাইতে জিম্মি থাকা অনেক তরুণী দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব। শতাধিক তরুণীর দেশে ফেরার কাকুতিমিনতির অডিও-ভিডিও রেকর্ডও সিআইডির হাতে এসেছে। আজম খানের মোবাইল ফোন থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বেশকিছু ভিকটিমের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তাদের জবানবন্দী ও বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। তারা অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, দুবাইয়ের স্থানীয় কিছু সদস্যও পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত, বলেন ওই কর্মকর্তা। এ চক্রের হোতা আজম খান ছাড়াও বেশ কয়েকজনের নাম আমরা জেনেছি। তদন্তের স্বার্থে এখন নামগুলো বলা যাচ্ছে না। তাদের অনেকের অবস্থানও আমরা নিশ্চিত করেছি। আন্তর্জাতিক এই নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে ভারতীয় ও পাকিস্তানী নাগরিকরাও রয়েছেন। তারা এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তাদের সম্পর্কে তথ্য বের করাটা বেশ কঠিন। দুবাইয়ে যে হোটেলগুলোতে বাংলাদেশীদের রাখা হয়, সেগুলোর পরিচালনায় রয়েছেন আজমের দুই ভাইÑ এরশাদ ও নাজিমউদ্দিন। তারা সেখানেই অবস্থান করছেন।
×