ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডিতে সংসদ সদস্যরা থাকতে পারবেন না

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৭ জুলাই ২০২০

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডিতে সংসদ সদস্যরা থাকতে পারবেন না

বিকাশ দত্ত ॥ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডিতে সভাপতি পদে সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন বা নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের সভাপতি হিসেবে নিয়োগ বা মনোনয়ন সংবিধানের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ সমস্ত কথা বলা হয়েছে। বিচারপতি আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের স্বাক্ষরের পর এ রায় প্রকাশ করা হয়। সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে তা দেয়া হয়েছে। রায় প্রকাশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোঃ হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, এ রায়ের ফলে সংসদ সদস্যরা আর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডিতে সভাপতি হতে পারবেন না। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একজন সংসদ সদস্যকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হয়। অপরদিকে গবর্নিং বডি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পদমর্যাদা সংসদ সদস্যের নিচের পদমর্যাদার। সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য যদি গবর্নিং বডির সভাপতি হন তাহলে কার্যত ওই গবর্নিং বডি একটি ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে বাধ্য। রায়ে আরও বলা হয়, একজন সংসদ সদস্যকে তার প্রজ্ঞা এবং জ্ঞান দিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য উন্নতির জন্য উন্নয়ন জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করার জন্য সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয়। সংসদ সদস্য থেকে স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হয়। সংসদ সদস্যরা হবেন বিজ্ঞ, জ্ঞানী, সাহসী, সৎ, নির্লোভ এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তিনি কখনই তার পদমর্যাদার নিচের কোন পদে নিজেকে অধিষ্ঠিত করবেন না। প্রত্যেক সংসদ সদস্য তার এলাকার কার্যত নির্বাচিত অভিভাবক, তিনি তার এলাকার অভিভাবক হিসেবে সকল গবর্নিং বডিরও অভিভাবক। তিনি কখনই গবর্নিং বডির সভাপতির পদ পাওয়ার চেষ্টা করবেন না। একজন সংসদকে দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যেমনইভাবে ভাল ভাল আইন প্রণয়ন করতে হয় তেমনইভাবে তার এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্যও সর্বক্ষণিকভাবে নিজেকে নিয়োজিত রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগের উপরিল্লিখিত রায় ও আদেশ পর্যালোচনায় এটা কাঁচের মতো স্পষ্ট যে, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডিতে জাতীয় সংসদদের সম্মানিত সদস্যগণ সভাপতি হিসেবে নিয়োগ/মনোনয়ন সংবিধানের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সংসদ সদস্যগণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে সর্বক্ষণিক নিবেদিত থাকতে হয়। এছাড়া গবর্নিং বডির সভাপতির পদ সংসদ সদস্যদের মহান পদের সঙ্গে একেবারেই বিপরীত। সংসদ সদস্যগণ তার নির্বাচিত এলাকাসহ সমস্ত দেশের উন্নয়নে নিবেদিত, অপরদিকে গবর্নিং বডির সভাপতি শুধু উক্ত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নিবেদিত। রায়ের আদেশে বলা হয়, অত্র রুলটি বিনা খরচায় চূড়ান্ত করা হলো। তিন নং প্রতিপক্ষ কর্তৃক ২০১৬ সালের ১৬ জুন ইস্যুকৃত পত্রটি এতদ্বারা বাতিল করা হলো। অত্র রায় ও আদেশের অবিকল অনুলিপি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে দ্রুত অবহিত করা হোক। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ নবেম্বর এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ডিগ্রী কলেজের গবর্নিং বডির সভাপতি পদে সংসদ সদস্যদের অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দারকে সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার আতরজান মহিলা কলেজের সভাপতি পদে মনোনয়ন দেন। ওই মনোনয়নের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এস এম আফজালুল হক। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি ডিগ্রী কলেজের সভাপতি পদে সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন দেয়া কেন অবৈধ হবে না, এ মর্মে রুল জারি করেন। পরে ২০১৯ সালের ২৫ নবেম্বর হাইকোর্ট রুল যথাযথ ঘোষণা করে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(১) মোতাবেক আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদ-এর উপর অর্পিত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(২) মোতাবেক একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তিন শত সদস্য এবং অনুচ্ছেদ ৬৫(৩) দফায় বর্ণিত মহিলা সদস্য নিয়ে সংসদ গঠন করতে হবে এবং সদস্যগণকে সংসদ সদস্য হিসেবে অভিহিত করা হবে। অর্থাৎ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রেও আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সংসদ-এর সদস্যগণ হলেন সংসদ সদস্য। অর্থাৎ মূলত : জনগণের কল্যাণের নিমিত্তে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ সৃষ্টি। অপরদিকে তিন শত নির্বাচিত ও সংরক্ষিত পঞ্চাশ মহিলা সদস্যগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত। সংবিধান মোতাবেক সংসদ সদস্যগণের মূল কাজ হলো রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা। রায়ে বলা হয়, দরখাস্তকারী এসএম আফজালুল হক কর্তৃক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(অ)-এর অধীন দরখাস্ত দাখিলের প্রেক্ষিতে প্রতিপক্ষগণের উপর কারণ দর্শানো পূর্বক নিম্নোক্ত রুলটি ইস্যু করা হয়েছিল। অত্র রুলটি নিষ্পত্তিতে ঘটনার বিবরণ এই যে, এম এ রহিম রানা মোকদ্দমার (৩৬ ডিএসআর ৩৬৮) সিদ্ধান্তের পরিপন্থীভাবে ৩নং প্রতিপক্ষ বিগত ২০১৬ সালের ১৬ জুন তর্কিত পত্রটি ইস্যু করায় দরখাস্তকারী সংক্ষুব্ধ হয়ে অত্র রিট পিটিশন দাখিল করে রুলটি প্রাপ্ত হন। রিট পিটিশনের পক্ষে এ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পূর্বক নিবেদন করেন যে, এম এ রহিম রানা মোকদ্দমায় এবং মোঃ আমির কুদরত-ই-ইলাহী খান মোকদ্দমায় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংসদ সদস্যগণের কোন বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ/মনোনয়ন-এর কোন সুযোগ বা অবকাশ নেই। মামলা শুনানি করেন দরখাস্তকারীর পক্ষে এ্যাডভোকেট মোঃ হুমায়ুন কবির। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী। সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল ইলিন ইমন সাহা, সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফিরোজ ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান লিখন।
×