ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৭ জুলাই ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ জীবন থেমে থাকে না। যত বড় ঝঞ্ঝাই আসুক, একসময় তাকে পেছনে ফেলে জীবন এগিয়ে যায়। এ সত্য অনাদিকাল ধরে আমরা জেনে ও মেনে এসেছি। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রচলিত অনেক বিশ্বাসকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। একই কারণে প্রায় থমকে গিয়েছিল ঢাকার জীবন। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছিল আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ। কিন্তু এভাবে কতদিন? জীবন তাই জীবনের নিয়মেই স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে। অঘোষিত লকডাউন তুলে নেয় সরকার। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা সাধারণ ছুটি বাতিল করে। সরকারী-বেসরকারী অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব কিছু সীমিত আকারে খুলে দেয়া হয়। এ জন্য সরকারকে প্রচুর সমালোচনা সইতে হয়েছে। সমালোচনা করাই যাদের একমাত্র কাজ তারা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারের মু-ুুপাত করেছেন। অন্যরাও খুব বেশি ছেড়ে কথা বলেননি। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস সব বন্ধ থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে? মধ্যবিত্তরা টিকে থাকতে পারবে তো? আরও অনেক প্রশ্ন। এসব মৌলিক প্রশ্ন মাথায় রেখে লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল করে সরকার। করোনা ইস্যুতে ভয় নয় বরং সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য সব কিছু বন্ধ না রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। প্রথম দিকে নানা সংশয় সন্দেহ নিয়ে কাজে যোগ দেয় রাজধানীর মানুষ। ক্রমে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। বর্তমানে এ শহর কর্মমুখর। নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিছু না কিছু করে খেতে পারছেন। অন্যরাও বসে নেই। জরুরী কাজ সম্পন্ন করার মতো লোকবল আছে সরকারী-বেসরকারী অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছেন। এখন মাস্ক পরার হার শতভাগ বললেও বিশেষ ভুল বলা হবে না। খুব কম লোকই মাস্ক ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন। একটু পর পর সাবানপানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছেন তারা। স্যানিটাইজারের শিশি রাখছেন পকেটে বা ভ্যানিটিব্যাগে। কিছুক্ষণ পর পর হাত স্যানিটাইজ করছেন। কেউ কেউ সার্জিক্যাল গ্লাভস ব্যবহার করছেন হাতে। চোখে সেফটি গ্লাস। পিপিই পরেও বের হতে দেখা যাচ্ছে। বিগত দিনের মতো যেখানে সেখানে কেউ হাত রাখছেন না। প্রস্তুতি ছাড়া স্পর্শ করছেন না কিছু। গল্প আড্ডা অনেক কমেছে। যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব মানছেন ঘরের বাইরে আসা মানুষজন। কলকারখানা শপিংমল ব্যাংক বীমা সর্বত্রই নেয়া হয়েছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। ঢাকার পাড়া মহল্লার দোকানপাটও এসবের বাইরে নয়। এ প্রসঙ্গে পুরনো এয়ারপোর্ট রোডের পার্শ্ববর্তী একটি মিষ্টির দোকানের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দোকানটির নাম ‘সর মালাই।’ বৃহস্পতিবার পাড়ার ছোট্ট দোকানে ঢুকে দোকানির সচেতনতা দেখে চমকিত হতে হলো। পণ্য কিনে ক্রেতা যে টাকা দিচ্ছিলেন সে টাকার প্রতিটি নোট ক্যাশ কাউন্টারের সামনে রাখা সাবান পানিতে ধুয়ে নিচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে মনোজ নামের এ দোকানি বললেন, টাকার নোট তো হাতে হাতে ঘুরে। নোটের গায়ে এমনিতেই নানা জীবাণু লেগে থাকার কথা শুনেছি। আর এখন তো সারা দুনিয়াজুড়েই করোনা চলছে। এ অবস্থায় সতর্ক না হওয়ার কোন বিকল্প নেই। এ কারণেই সব নোট সাবান পানিতে ধুয়ে গ্রহণ করেন বলে জানান তিনি। বলেন, বহুদিন দোকান বন্ধ রেখেছি। অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু আর কত ক্ষতির মুখে পড়ব? জীবন তো চালাতে হবে? এ কারণেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান পরিচালনা করছি। আরও একটি অদ্ভুত বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। শহর ঢাকায় করোনাই করোনার ভয় দূর করতে ভূমিকা রাখছে। কিছুদিন আগেও পরিচিত কারও করোনা হয়েছে শুনলে সংশ্লিষ্টদের চোখ বড় হয়ে যেত। দৌড়ে পালাত সবাই। ধারে কাছে ঘেঁষত না। আপনজনরাও খোঁজ নিতে চাইত না রোগীর। আক্রান্তের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণের কথাও আমরা বিভিন্ন সময়ে জেনেছি। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার প্রায় সব পাড়া মহল্লা বা ঘরেই কম বেশি রোগী আছে। বাবা মা সন্তান ভাই বোন কিংবা নিকটাত্মীয়রা আক্রান্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় ভয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ভালবাসা। ‘করোনা’ বলে আতঙ্কে ছোটাছুটি করছে না মানুষ। বরং করোনা এখন হয়ে গেছে ‘পজিটিভ।’ নিকটজনরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে একে অন্যের শুশ্রƒষা করছেন। একই বাসার এক কক্ষে বাস করছেন রোগী। অন্য কক্ষে সুস্থ মানুষ। সুস্থ মানুষ অসুস্থকে সারিয়ে তুলছেন। এমনকি এখন বাসায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাই বেশি! তার মানে, একই বার্তা পাচ্ছি আমরা। করোনায় ভয় নয়, সচেতন হতে হবে।
×