ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট পণ্যে বড় আশা-

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১৭ জুলাই ২০২০

ছোট পণ্যে বড় আশা-

রহিম শেখ ॥ বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দেশের রফতানি আয়ের বড় খাত তৈরি পোশাক কিংবা চামড়ায় ধস নামলেও আশার আলো দেখিয়েছে ছোট ছোট পণ্য। এরমধ্যে ওষুধ, ফলমূল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কাঁচা পাট, শাকসবজি, জুতা (চামড়া ব্যতীত), আসবাব, কার্পেট, জুট ইয়ার্ন এ্যান্ড টোয়াইন, গলফ সাফট, তামাক, জাহাজ, চা, হ্যান্ডিক্রাফটস, আর ছাই রফতানি করে গত অর্থবছরে আয় হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার। দেশের ৭৫০টি পণ্য রফতানি হলেও করোনার এই সময়ে একেবারেই নতুন পণ্য হিসেবে রফতানি খাতে বৈচিত্র্য এনেছে পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, গাউন, মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের চাহিদা এখন তুঙ্গে। এ খাতের উদ্যোক্তারা আশা করছেন, চলতি বছরে দেশে এ সুরক্ষা সামগ্রীগুলোর আরও অর্ডার আসবে। ফলে এ পণ্যগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে রফতানির নতুন সম্ভাবনা। গত কয়েক মাস ধরেই করোনায় কাবু গোটা বিশ^। নোভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা কমে আসায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল দেশের রফতানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও চামড়া রফতানি। দুটি খাতই রফতানির দিক থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয়। তবে রফতানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে রীতিমতো করোনা জয় করেছে ছোট ছোট কিছু পণ্য। লকডাউন, কারখানা বন্ধ এমন কি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিলের মতো নেতিবাচক সিদ্ধান্তগুলোও এসব খাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওষুধ, ফলমূল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কাঁচা পাট, জুট ইয়ার্ন এ্যান্ড টোয়াইন, গলফ সাফট, তামাক, জাহাজ, শাকসবজি, জুতা (চামড়া ব্যতীত), আসবাব, কার্পেট, চা, হ্যান্ডিক্রাফটস ও ছাই। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশের ৭৫০টি পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে ৬০০ পণ্য বাড়তি সুযোগ পায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের রফতানি আয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের স্বাস্থ্য খাতের পণ্য ওষুধ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ, জুতায় (চামড়া ব্যতীত) ২ দশমিক ৬ শতাংশ, হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্যে ২.৮৬ শতাংশ, পাট ও পাটজাত পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি, কাঁচা পাটে ১৫.৪৮ শতাংশ, চা রফতানিতে ১০.৬৪ শতাংশ, কার্পেটে ৮.৪১ শতাংশ, প্রকৌশল যন্ত্রাংশে ২৬ শতাংশ, জুট ইয়ার্ন এ্যান্ড টোয়াইন পণ্যে ১০.১২ শতাংশ, গলফ সাফট পণ্যে ২০ শতাংশ, তামাকে ২৬.৮৯ শতাংশ, জাহাজে ১৩৯ শতাংশ, ফলমূল রফতানিতে ৪৮ শতাংশ ও সবজি রফতানিতে ৬৪.৫৩ শতাংশ ও ছাই রফতানিতে ৬৪.৫৩ শতাংশ। এসব পণ্য থেকে গত অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ১৬৬ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এর মধ্যে ওষুধে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, পাট ও পাটজাত পণ্যে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার, কাঁচা পাটে ১২ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, জুতা (চামড়া ব্যতীত) পণ্যে ২৭ কোটি ৭১ লাখ ডলার, আসবাবে ৭ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্যে ২ কোটি ডলার, ফলমূলে ৪৯ লাখ ডলার, চায়ে ৩১ লাখ ২০ হাজার ডলার, প্রকৌশল যন্ত্রাংশে ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, কার্পেটে ২ কোটি ১১ লাখ ডলার, জুট ইয়ার্ন এ্যান্ড টোয়াইনে ৫৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার, গলফ সাফটে ১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, তামাকে ৮ কোটি ডলার, জাহাজে ১ কোটি ১৩ লাখ ডলার, সবজিতে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ছাই রফতানি করে আয় হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার আয় হয়েছে। বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মোর্শেদী বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের রফতানি আয়ের খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ছোট পণ্যগুলো বেশ ভাল করছে। সুংসবাদ হলো, করোনাভাইরাসে বিশ্ব যখন টালমাটাল, এই সময়টায় বাংলাদেশের এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।’ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান বলেন, প্রবৃদ্ধি কম হলেও বছর শেষে মোট রফতানিতে করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বেশ সক্ষম হয়েছে। সর্বশেষ জুন মাসে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রফতানি আয়। এ ছাড়া সরকারের দেয়া প্রণোদনাও কাজ করতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমার্শিয়াল উইং ও উদ্যোক্তারা রফতানিতে ঘুরে দাঁড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সুরক্ষা সামগ্রী রফতানিতে আয় বাড়ছে ॥ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি রফতানি খাতের জন্য কিছু সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। রফতানি তালিকায় যুক্ত করেছে নতুন কিছু পণ্য, ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) হিসেবে যার চাহিদা বেড়েছে পুরো বিশ্বে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষের জীবনযাপনের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বেড়েছে মাস্ক বা মুখোশের ব্যবহার। মাস্ক ছাড়াও যে পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে আছে মেডিকার্ট রোবট এবং জীবাণুনাশক রিমোট কন্ট্রোল ইউভি-সি সিস্টেম, ভেন্টিলেটর বা অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র, ফেস প্রোটেকটিভ শিল্ড, সেফটি গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও থার্মোমিটার। বর্তমানে ঢাকা ও তার আশপাশে সাভার ও গাজীপুরের ৩৩টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) ও ফেসিয়াল মাস্ক। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মোট ১১.৫৮ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই রফতানি করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত মাসেও এ পণ্যগুলো বিপুল পরিমাণ রফতানি করা হয়। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট আরশাদ জামাল বলেন, বেশ কিছু দেশীয় কারখানা পিপিই ও মাস্ক তৈরি করছে। ধারণা করছি বছরজুড়ে এ ধরনের পণ্যের আরও অর্ডার আসবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মেডিক্যাল গাউন, গ্লাভস জাতীয় সুরক্ষা উপকরণ রফতানি করেছে বাংলাদেশ। দেশীয় কোম্পানি বেক্সিমকো সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ লাখ মেডিক্যাল গাউন রফতানি করে। চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটির কমপক্ষে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সুরক্ষা উপকরণ রফতানির লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সৈয়দ নাভেদ হুসাইন জানান, পিপিই উৎপাদনের নতুন কেন্দ্র হয়ে ওঠার মতো সব সুযোগ এখন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে। এটা বিশ্ববাসীকে যেমন সুরক্ষিত করবে, ঠিক তেমনি গার্মেন্টস খাতের ৪১ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা তৈরির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক অবদান রাখবে। দেশের আরেক প্রতিষ্ঠান ¯েœাটেক্সও ফেসিয়াল মাস্ক রফতানি করেছে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফেস্ক মাস্ক একটি ফরাসী প্রতিষ্ঠানের কাছে রফতানি করেছে। মাস্ক এবং স্পনসারের জন্য প্রতিষ্ঠানটি আরও এক লাখ পিপিই তৈরি করছে। বৈচিত্র্য আসছে নতুন পণ্য রফতানিতে ॥ শুধু পিপিই নয়, মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট ও সলিউশন তৈরি করছে দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে ওয়ালটন, মিনিস্টার, স্কয়ার ও এসিআইয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অতি সম্প্রতি দেশীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস ধ্বংস করে এমন কাপড় প্রস্তুতের কথা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নতুন এসব পণ্যের মাধ্যমে রফতানিতে বৈচিত্র্য আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) ওবায়দুল আজম। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে সুরক্ষা উপকরণের মতো পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সুরক্ষা উপকরণ, মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট, করোনা ধ্বংস করে এমন কাপড় এই পণ্যগুলো রফতানি ঝুড়িতে নতুন সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আগামী এক বছর এ ধরনের পণ্যের চাহিদা থেকেই যাবে। সরকার এ ধরনের পণ্য উৎপাদকদের সহযোগিতায় তাদের পাশে আছে। যদি কোন ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তা করা হবে। আশা করছি নতুন পণ্যগুলো আগামী দিনগুলোতে ব্যাপক হারে রফতানি বেড়ে যাবে। রফতানির ক্ষেত্রে অতি সম্প্রতি যে পণ্যটির চাহিদার বিষয়ে বহির্বিশ্ব থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো করোনা ধ্বংস করতে সক্ষম এমন কাপড়।
×