ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১৮ জেলায় বিস্তৃতি

বন্যার কোথাও উন্নতি কোথাও অবনতি

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ১৭ জুলাই ২০২০

বন্যার কোথাও উন্নতি কোথাও অবনতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি আবার কোথাও অবনতির আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। তারা জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অপর দিকে এই সময়ের মধ্যে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী এবং ঢাকা জেলার নিম্নঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এছাড়াও অপরিবর্তিত থাকবে গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতি। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাত দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের ১৮ জেলায় বন্যা বিস্তৃত হয়েছে। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২২ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭২ জন। সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যায় ১৮টি জেলার ৯২ উপজেলার ৫৩৫টি ইউনিয়ন দুর্গত হয়েছে। বন্যায় জামালপুরে চারজন এবং লালমনিরহাট, সুনামগগঞ্জ, সিলেট ও টাঙ্গাইলে একজন করে মোট আটজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১২ জেলায় এক হাজার ৫৪৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ২০ হাজার ৭০৫ জন এবং ৫৬ হাজার ৩১টি গবাদিপশু আশ্রয় পেয়েছে। ৫৯৬টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হলেও এর মধ্যে ১৯৭টি টিম কাজ করছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আনসার, গ্রাম পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক ও এনজিও প্রতিনিধিরা কাজ করছেন। কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি সবাইকে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। সব জেলায় ধান কাটা শেষ হওয়ায় বন্যায় ধানের ক্ষতি হয়নি। পাট, ডাল ও শাকসবজির কিছু ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া আমন ধানের বীজতলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি সামলাতে কৃষি মন্ত্রণালয় উঁচু জায়গায় আমনের বীজতলা করে কৃষকদের বিনামূল্যে তা সরবরাহ করবে। তিনি বলেন, এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ নদ-নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমতে শুরু করবে। এদিকে বন্যা সংক্রান্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি সমতলে স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। অপর দিকে যমনা নদীর পানি সমতলে বাড়ছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি হ্রাস পাওয়া শুরু হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। অপর দিকে ৪৮ ঘণ্টা নাগাদ পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তারা জানায়, কুশিয়ারা নদী ব্যতীত উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার সব নদীর পানি হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এটা অব্যাহত থাকবে। তারা আরও জানায়, নদ-নদীর পানি পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত ১০১টি সমতল স্টেশনের মধ্যে ৫৫টি স্টেশনের এখনও পানি বাড়ার তথ্য রয়েছে। অপর দিকে কমেছে ৪৫টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এখনও ২২টি স্টেশনের পানি। এর মধ্যে করতোয়া নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। আগ থেকে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, যমুনা, আত্রাই, গুড় ধলেশ্বরী, ছোট যমুনা, পদ্মা, সুরমা কুশিয়ারা এবং পুরাতন সুরমা নদী গত প্রায় এক সপ্তাহ যাবত বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, গঙ্গা ও পদ্মার পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা বেড়ে এরপর কমার পূর্বাভাস রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি কমছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালাপুর, নাটোর ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে আগামী একদিনে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আক্রান্ত এলাকায় চার হাজার ৮৫০ টন চাল বিতরণ এবং এক কোটি ৯১ লাখ টাকা নগদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৮২২ প্যাকেট। শিশুখাদ্য কেনা বাবদ ২১ লাখ ও পশু খাদ্যের জন্য ২১ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। এদিকে দেশের কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির আভাস পাওয়া গেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে ২০ জুলাইয়ের পর থেকে দেশের বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হবে। বন্যার সর্বোচ্চ পিক টাইম হবে ২৫ জুলাই। এরপর থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করবে। তবে এই সময়ের পরে পানি নতুন করে নাও বাড়তে পারে। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, বন্যায় দেশের নদ-নদীর পানি বাড়ার সময়কাল ধরা হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এই সময়ে মধ্যে পানি কমলেও আবারও তা যে কোন সময়ের মধ্যে বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে বন্যা ছিল মূলত আগস্ট মাসজুড়ে। ইতোমধ্যে বাংলা শ্রাবণ মাস শুরু হয়েছে। সাধারণত এই মাসে বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে। শ্রাবণের ধারা মধ্য আগস্ট পর্যন্ত চলে। দেশের বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি বগুড়া ॥ যমুনার পানি রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির পথে। চলতি মৌসুমে এখন যমুনার পানি বিপদ সীমার সর্বোচ্চ অবস্থ’ানে। আর ২ সেন্টিমিটার পানি বাড়লেই বগুড়ায় বিপদসীমার ওপর দিয়ে যমুনার পানি আগের রেকর্ড অতিক্রম করবে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদী তীর এলাকা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া দুর্ভোগে পড়া লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। জেলার ৪৩ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় পানি চুইয়ে (সিপেজ) পড়তে শুরু করছে। সবচেয়ে বেশি সিপেজ হচ্ছে জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এলাকায়। এখানকার ২৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ১৫ কিলোমিটিার এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পানি কম বেশি সিপেজ হচ্ছে। গাইবান্ধা ॥ ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ এখন বন্যাকবলিত। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চারটি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৬ হেক্টর জমির পাট, আমন বীজতলা, আউশ ধান ও শাকসবজিসহ অন্য ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র দুধকুমোরসহ প্রতিটি নদীর পানি সামান্য কমলেও বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বইছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রবল স্রোতে রৌমারীর উপজেলা শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে উপজেলা চত্বরসহ নতুন করে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বুধবার রাতে শহর রক্ষা বাঁধটি ভেঙ্গে প্লাবিত হয়। রৌমারী বাজার ও উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী-বেসরকারী অফিস আদালত পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় জেলার ৬২ ইউনিয়নের ৫৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে সাড়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নতুন করে তলিয়ে গেছে রৌমারীর ১৫টি গ্রাম। নওগাঁ ॥ নওগাঁর দুই উপজেলায় আত্রাই নদীর পৃথক ৯টি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় ওই দুই উপজেলার কমপক্ষে ৭টি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জেলার মান্দা উপজেলায় জোতবাজার-আত্রাই সড়কের মাত্র ৬ কিলোমিটারের মধ্যে ভাঙ্গনকৃত এসব চার স্থান দিয়ে একই এলাকায় হু-হু করে প্রবেশ করছে পানি। বুধবার বিকেল থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থান ভেঙ্গে অন্তত অর্ধ শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকার বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন সড়ক ও উঁচু স্থানে। মানিকগঞ্জ ॥ ২৪ ঘণ্টায় শিবালয় উপজেলার আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর ৩০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় দ্রুতগতিতে পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার শিবালয়, দৌলতপুর এবং ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলে পানি প্রবেশ করছে। এর ফলে এসব এলাকার নিম্নঞ্চলের বাড়িঘর এবং ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। দৌলতপুর উপজেলার চরাঞ্চলের বাচামারা, বাঘুটিয়া ও চরকাটারী ইউনিয়নের দেড় শতাধিক ঘর বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। শিবালয়, দৌলতপুর ও ঘিওর উপজেলায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
×