ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর ॥ এর আগেও গ্রেফতার হয়েছিল

আদালতেও সাহেদের প্রতারণা- করোনা রোগী দাবি

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ১৭ জুলাই ২০২০

আদালতেও সাহেদের প্রতারণা- করোনা রোগী দাবি

আজাদ সুলায়মান ॥ গ্রেফতারের পর থেকেই অসুখের ভান করছে মহাপ্রতারক সাহেদ। কখনও বুকের ব্যথা, কখনও মাথা ঘুরানো। তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নিজেকে করোনা রোগী হিসেবে আদালতে কান্না। কিন্তু নিস্তার মিলেনি। তদন্তকারী গোয়েন্দারা তার অভিযোগ আমলে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এতে সত্যতা মিলেনি তার অভিযোগের। তবে তার করোনা পরীক্ষাও করা হবে বলে জানিয়েছে ডিবি। এই প্রতারককে বৃহস্পতিবার দশ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এদিকে ২০১৬ সালেও সাহেদ চেক জালিয়াতির মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল। কিন্ত হাইপ্রোফাইল তদ্বিরের জোরে জেল থেকে ছাড়া পায়। তারপর থেকেই আরও ভয়ঙ্কর ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। র‌্যাব জানিয়েছে, বুধবার উত্তরায় তার বাসা থেকে জাল টাকা উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনেই করোনা চিকিৎসা প্রতারণায় টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করেছে সাহেদ। বৃহস্পতিবার বিকেলে সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে এ কথা জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এই প্রতারক জীবনের প্রতিটি পদে পদে প্রতারণাকে এত নৈপুণ্যের সঙ্গে উপস্থাপন করেÑ যাতে সচেতন মানুষও বিভ্রান্ত না হয়ে পারেন না। বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করার আগ মুহূর্ত থেকেই সাহেদ করোনা রোগী বলে দাবি করতে থাকে। এমনকি আদালতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহেদ বলল, আমি নিজেও করোনা রোগী। আমার বাবাও করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। একমাত্র আমিই বেসরকারী হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দেই। আমি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হলে রিমান্ড শুনানির মাঝখানে বিচারককে সে এসব কথা বলেন। এই প্রতারককে বুধবার সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় আনার পর দাবি করে তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে তার এক্সরে ও ইসিজি করা হয়। যদিও চিকিৎসক ও র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, সব রিপোর্ট ভাল এসেছে, কোন সমস্যা নেই। করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদকে বৃহস্পতিবার সকালে আদালতে তুলে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চায়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন তার কিছু বলার আছে কিনা। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহেদ নিজেকে করোনা রোগী দাবি করে এসব কথা বলে। এ সময় উত্তরা পশ্চিম থানার মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা এসএম গাফ্ফারুল আলম রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ও এমডি মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই মামলার আরেক আসামি তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আবার ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন একই তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে বিচারক সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পশ্চিম থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এই তিনজনের রিমান্ডের আবেদন করলে শুনানি শেষে বিচারক আদেশ দেন। সাহেদের অসুস্থতার খবর কতটা সত্য জানতে চাইলে গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, এটা হাস্যকর। সাতক্ষীরায় তাকে নৌকা থেকে আটক করার পরই সে ভাল লাগছে না, শরীর খারাপ বলে দাবি করে। ঢাকায় আনার পর হেলিপ্যাড থেকে মাইক্রোবাসে তোলার সময়েও চরম উত্তেজিত হয়ে তার শরীর খারাপ লাগার কথা বিষয়টি প্রকাশ করে। র‌্যাব অফিসে কয়েক ঘণ্টা রাখার পর ডিবিতে নেয়ার সময় সে জানায়, বুকে প্রচ- ব্যথা। সেটা আমলে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়। তারপর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই করোনা বলে দাবি করতে থাকে যা হাকিমের সামনেও দাঁড়িয়ে তাকে একই সমস্যা নিয়ে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। মূলত সে জিজ্ঞাসাবাদ এড়ানোর জন্যই এমন ধূর্ত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তার দাবি মতে, দেড় মাস ধরে করোনা। চিকিৎসকরা তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, দেড় মাস ধরে করোনা থাকলে মেজর সিমটপ দেখা দিত। এমন কিছু নেই তার মাঝে। এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথমদিনেই গোয়েন্দা পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার করেছে সাহেদ। এছাড়া হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানের আগে কিছু যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলেছে বলেও জানিয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, অভিযান চালিয়ে সেগুলো উদ্ধার করা হবে। দুপুরে ডিবি কার্যালয়ের গেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অনেক কিছুই বলেছে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে। তবে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পালিয়ে থাকার ব্যাপারেও কথা বলেছে। টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়েও কথা বলেছে। অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন আরও বলেন, প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলার তথ্য আসছে। অনেক মামলা। সব মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাত্রই রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে সব তথ্য বের হয়ে আসবে। গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, র‌্যাবের অভিযানের আগে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে যন্ত্রপাতিসহ বেশকিছু সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বলে জানিয়েছে সাহেদ। ডিবির অভিযানে এসব যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হবে। করোনাকালীন দুই মাসে অন্তত চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছে প্রতারক সাহেদ। হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বেশি দামে পণ্য এনে কম দামে বিক্রি করে টাকা পকেটে ভরেছে। অথচ কারও টাকা পরিশোধ করেনি। তার বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলোও একে একে স্বীকার করছে। রিমান্ডে সাহেদ ও মাসুদকে আলাদা আলাদা এবং মুখোমুখি করেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এদিকে জালনোট উদ্ধারের ঘটনায় প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার রিজেন্টের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। বৃহস্পতিবার দুপুরে র‌্যাবের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, রিজেন্টের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমের উত্তরা কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে জালনোট উদ্ধারের ঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারের পর সাহেদ করিমকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলার তার একটি গোপন কার্যালয় থেকে জাল ১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। সেইসঙ্গে একটি স্যুটকেস থেকে তার কিছু কাপড় ও জুতা উদ্ধার করা হয়। এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে র‌্যাব বাদী হয়ে সাহেদের বিরুদ্ধে জালনোট উদ্ধারের ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে। র‌্যাবের ডিএডি মজিবুর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। উল্লেখ্য, বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয় সাহেদকে। এর আগে তার খোঁজে সোমবার মৌলভীবাজারে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। তবে সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে র‌্যাবের অভিযানের পর থেকে পলাতক ছিল সাহেদ। গত ৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে র‌্যাব রিজেন্ট হাসপাতাল ও তার মূল কার্যালয় সিলগালা করে দেয়। সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনই উত্তরা পশ্চিম থানায় নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়। তার হাসপাতালের কার্যক্রমও সরকারের নির্দেশে বন্ধ আছে। তার অন্য সহযোগীদেরও গ্রেফতারের অভিযানে মাঠে রয়েছে র‌্যাব।
×