ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:৫০, ১৬ জুলাই ২০২০

কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

আজকের এই দিনে ২০০৭-এ সেদিনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা বড় আপাকে (শেখ হাসিনা) গ্রেফতার করে জাতীয় সংসদ ভবনে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে পাঠানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিল। আপাকে গ্রেফতারে সেদিনের পুলিশ বাহিনী শিষ্টাচারের কোন তোয়াক্কাই রাখেনি। সেদিনের সেসব ছবি আজও পত্র-পত্রিকা আর টিভির পর্দায় আমাদের পীড়া দেয়। আর যেসব তথাকথিত অপরাধের অজুহাতে আপার সর্বশেষ জেলযাত্রা, সময়ের পরিক্রমায় মিথ্যে প্রমাণিত তার সব কয়টি। তবে সেসবের অবতারণা আজকের লেখার প্রেক্ষাপট নয়। একজন শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে বাংলাদেশের গৌরব গাথা আজ কখনও পদ্মায় তো, কখনও অন্তরিক্ষে। আমরা যেমন ধান ফলাতে জানি, পারি তেমনি নিজ দেশে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র বানাতেও। সেসব উন্নয়নের ফিরিস্তির খাতা খুলে বসার তাগিদ থেকেও এই লেখার অবতারণা নয়। আপার এই সর্বশেষ জেলযাত্রাটি নানা কারণেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আপা ছিলেন সম্ভবত বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজবন্দী। রাজনীতি করলে জেলে যেতে হবে, ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই সংস্কৃতিটি সযতেœ লালিত হয়েছে ব্রিটিশ উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশে এবং ভারতে হয়তোবা কম। তবে একসময় পাল্লা দিয়ে এই সংস্কৃতির প্রচলন ছিল পাকিস্তান আর বাংলাদেশে। জাতির পিতাকে তাঁর জীবনের প্রায় এক পঞ্চমাংশ কাটাতে হয়েছে জেলখানার চৌদ্দ শিকের পেছনে। রাজনীতি করাটাই একটা সময় ছিল এদেশে অপরাধ, আর তা যদি হয় মানবতা, মানবমুখী রাজনীতি, তাহলে তো কথাই নেই। ২০০৮ এ জনচাহিদা পূরণের চাপে আপার কারামুক্তি আর তারপর ২০০৯ থেকে আপার নিরবচ্ছিন্ন শাসনে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে ‘রাজবন্দী’ শব্দটি। আপার পর শুধু রাজনীতি করার অপরাধে এদেশে কারাগারে যেতে হয়নি আর কোন রাজনীতিককে। এখন যারা কারাগারে যাচ্ছেন, যাবেন ভবিষ্যতেও, সেটা শুধু অপরাধের জন্য, রাজনীতির জন্য না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে ঝেটে বিদায় দেয়ার যে সংস্কৃতির চর্চার শুরু হয়েছে, সেই সংস্কৃতির একটি অনবদ্য অধ্যায় হচ্ছে রাজনীতি করার অপরাধে কারাবরণের সংস্কৃতিটির অবসান। শুধু মানবমুখী রাজনীতি করার অপরাধে বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজবন্দী শেখ হাসিনার সর্বশেষ কারাবরণের এই দিনটি তাই বাংলাদেশের রাজনীতিক সংস্কৃতিতে একটি বড় মাইলফলক। সেদিনের সেই শিষ্টাচারবর্জিত পুলিশ বাহিনীও আজ আমূলে পরিবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পুলিশ আজ মানবিক পুলিশ। আজ করোনার মৃতের জানাজায় পুলিশ, দাফনেও তারাই। কোভিড ঠেকাতে গিয়ে তারাও নিজেরাই আক্রান্ত হচ্ছেন। শুধু কোভিড আক্রান্ত পুলিশ সদস্যে উপচে পড়ছে ঢাকার একাধিক হাসপাতাল। মৃত্যুবরণও করেছেন প্রায় অর্ধশত পুলিশ বাহিনীর সদস্য কোভিডে আক্রান্ত হয়ে। আজকের পুলিশের সঙ্গে সেদিনের পুলিশের যে পাহাড় প্রমাণ ব্যবধান, সেই ব্যবধানটির মাপকাঠিও ২০০৭-এর ১৬ জুলাইয়ের সেই ছবিগুলো। বাঙালীকে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে উল্টোপথে চালিত করার যে প্রয়াস ক্রমাগত অব্যাহত ছিল, ১৯৯৬ এর পর পাঁচটি বছর বাদ দিয়ে, পঁচাত্তর এর পর থেকে অবিরত, তারও স্থায়ী যবনিকাপাত হয়েছে ২০০৭ এর ১৬ জুলাই আপার ঐ জেলযাত্রার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়েই। ইতিহাসকে বিকৃত করার যে বিকৃতিতে এই লম্বা সময়টায় দেশের শাসকদের পেয়ে বসেছিল, তার হিং¯্র থাবা থেকে রক্ষা পায়নি দেশের একটি খাতও। এই বিকৃতির স্মারক স্তম্ভটি হচ্ছে আমার দৃষ্টিতে লুই কানের নকশাকে পায়ে মাড়িয়ে দৃষ্টিনন্দন জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে কবরস্থান আর কারাগার নির্মাণ। আজ আপার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। দাঁড়ায়নি পুরোপুরি এখনও। এখনও যেমন বাকি আছে জাতীয় সংসদের প্রাঙ্গণ থেকে কবরস্থান সরানো, তেমনি বাকি আছে জঞ্জাল সরানোর আরও কিছু। শুধু সাবরিনা আর সাহেদের জেলযাত্রার মধ্য দিয়ে সব ময়লা মুছে যায় না। এখনও যখন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজের উল্লাস ঢাকতে না পেরে নির্লজ্জ স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে, তখন হাড়ে হাড়ে বুঝি ১৬ জুলাইয়ের অপরাধীদের আজকের বাংলাদেশ থেকে দশকব্যাপী অনুপস্থিতিও বাংলাদেশকে দুর্নীতি আর অনাচারের সংস্কৃতি থেকে এখনও পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। এখনও বাকি আছে পথ অনেকটাই-ই। তবে এও জানি, সে পথ আমরা নিশ্চয়ই পাড়ি দেব, আর তা পাড়ি দেব বড় আপার হাত ধরেই। লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×