ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার সঙ্গে চীনের নতুন করে উত্তেজনা বাড়ছে

প্রকাশিত: ১০:১২, ১৫ জুলাই ২০২০

আমেরিকার সঙ্গে চীনের নতুন করে উত্তেজনা বাড়ছে

অনলাইন ডেস্ক ॥ এবছরটা চীনের জন্য কঠিন সময়। এ পর্যন্ত, এ বছর চীনকে ইতোমধ্যেই যেসব বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাস, আমেরিকার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ, হংকং-য়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন এবং নানা অর্থনৈতিক টালমাটাল। এসবের সাথে এখন যোগ হয়েছে বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সম্প্রতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা বড়ধরনের উত্তেজনা। আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও প্রথমবারের মত বলেছেন দক্ষিণ চীন সাগরের যেসব অঞ্চল, চীন নিজের বলে দাবি করছে তা ''সম্পূর্ণ অবৈধ''। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেছেন সিঙ্গাপুরে কৌশলগত একটি পরামর্শ সংস্থার পরিচালক ও সামরিক বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নেইল। দক্ষিণ চীন সাগর গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নৌ চলাচল পথ। তবে বহু বছর ধরে এই সাগরের ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপ, যার অনেকগুলোই প্রবাল দ্বীপ, প্রবালপ্রাচীর এবং দ্বীপগুলোর সম্পদের মালিকানা দাবি করে আসছে ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ এবং অনেকদিন ধরেই এই সাগর ওই অঞ্চলে একটা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন এই এলাকায় তাদের মালিকানার দাবি নিয়ে ক্রমশ আরও বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। দেশটি দাবি করছে বিতর্কিত এই এলাকাটি কয়েক শতাব্দী ধরে চীনের অংশ এবং চীন তাদের দাবির সমর্থনে সেখানে সামরিক উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে আরও জোরদার করেছে। আমেরিকার প্যাসিফিক কমান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস একসময় এটাকে উল্লেখ করেছিলেন "বালুর সুবিশাল প্রাচীর" হিসাবে। তিনি বলেছিলেন চীনের ঐতিহাসিক প্রাচীর- গ্রেট ওয়াল- যেমন চীনা ভূখণ্ডকে সুরিক্ষত রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল, তেমনি সাগরে ওই এলাকাকে সুরক্ষিত করতে চীন জায়গাটি ঘিরে তৈরি করেছে বালুর প্রাচীর। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন এবং আমেরিকার মধ্যে তীক্ষ্ম বাদানুবাদ হলেও, দুই দেশ এই বিরোধপূর্ণ এলাকা নিয়ে তাদের মতভেদ এতদিন পর্যন্ত, এক অর্থে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংঘাতের মধ্যেও ওই এলাকার মালিকানা নিয়ে আঞ্চলিক বিবাদে কোন পক্ষ নেয়নি আমেরিকা। তারা শুধু ওই অঞ্চলে তাদের জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতা দাবি করে এসেছে। এর মধ্যেই এসেছে কোভিড-১৯ মহামারি। এই করোনা প্রাদুর্ভাব চীন প্রথমদিকে কীভাবে মোকাবেলা করেছে তা নিয়ে আমেরিকার সমালোচনা চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে। চীনকে নিয়ে আমেরিকার সমালোচনা এবং মি. পম্পেও-র মন্তব্যকে আপাতদৃষ্টিতে বেশ কিছু পশ্চিমা নেতাকে সমর্থন করতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে দুই শক্তিধর দেশের মধ্যেকার উত্তাপ এখন ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ চীন সাগরেও। উদ্বেগজনক একটা সময়ে সামরিক উত্তেজনা এপ্রিলের গোড়ায় চীনা উপকূলরক্ষীদের একটি জাহাজ প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের কাছে ভিয়েতনামের একটি জেলে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। চীন এবং ভিয়েতনাম দুটি দেশই এই দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা দাবি করে থাকে। এর পরপরই বোর্নিও উপকূলের কাছে মালয়েশিয়ার একটি তেল উত্তোলন প্রকল্পের কাজে বাধা দেয় চীনা নৌ বাহিনী ও উপকূল রক্ষীবাহিনীর অধীনস্থ একটি চীনা পর্যবেক্ষণ জাহাজ। এর পরই আমেরিকান নৌবাহিনীর একটি রণতরী এবং অস্ট্রেলিয়ার একটি যুদ্ধজাহাজ কাছাকাছি সাগরে মোতায়েন করা হয়। আমেরিকা প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে তাদের নৌবাহিনীর আরও দুটি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী জাহাজ পাঠালে উত্তেজনা আরও বাড়ে। মাত্র কিছুদিন আগেই চীন, দক্ষিণ চীন সাগরের একটা অংশ বন্ধ করে দেয় প্যারাসেল দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রে নৌবাহিনীর মহড়া চালানোর জন্য। আমেরিকা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলে, চীন বিতর্কিত ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়াতে পারে এমন কর্মকাণ্ড না চালানোর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। উত্তরে আমেরিকা এলাকায় তার নৌ-শক্তির প্রদর্শন আরও জোরদার করে আরও রণতরী সেখানে মোতায়েন করে, যা চীনকে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ করে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে এই ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ছিল খুবই স্পষ্ট। আমেরিকান নৌবাহিনী ওই এলাকায় তাদের উপস্থিতি এরপর আরও জোরদার করেছে, যার মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মধ্যে বৈরিতা দ্রুত বেড়েছে, এবং একটা কিছু ঘটার আশংকা তৈরি হয়েছে। চীন ও ভারতের মধ্যে বিতর্কিত সীমান্তে সম্প্রতি যে প্রাণঘাতী সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, হংকংয়ে যেভাবে চীন জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি করেছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন দক্ষিণ চীন সাগরে কোনরকম হুমকি দেখা দিলে তা মোকাবেলায় চীন হয়ত সংযত আচরণ নাও দেখাতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের লক্ষ্য কী? চীন মনে করে দক্ষিণ চীন সাগর তার সমুদ্র এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। হাইনান দ্বীপে চীনের পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যে সামুদ্রিক ঘাঁটি রয়েছে শুধু সে কারণেই নয়, চীনের বিশাল বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রকল্প, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসাবে সিল্ক রোডের সামুদ্রিক পথও এই সাগর এলাকা। ফলে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য এই দক্ষিণ চীন সাগর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলোতে উন্নয়ন ও বসতি তৈরির বড়ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে। দ্বীপগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো চীন উন্নত করেছে। প্যারাসেলের দ্বীপগুলোতে ছোট ছোট জেলে গ্রামগুলোতে আধুনিক আবাসন তৈরি করে দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক স্কুল, ব্যাংক, হাসপাতাল এবং মোবাইল যোগাযোগের ব্যবস্থা বসিয়েছে। মূল ভূখণ্ড থেকে পর্যটকরা নিয়মিত প্রমোদতরীতে দ্বীপগুলো ভ্রমণে যায়। উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ অধিগ্রহণের কাজও চীন এগিয়েছে। প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। স্প্র্যাটলির ছোট ছোট প্রবালদ্বীপে গত ছয় বছরে চীন নৌ প্রকৌশল ও সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিমান অবতরণ ক্ষেত্র, নৌবাহিনীর রসদের মজুদ ও বিমান ঘাঁটি, গোলবারুদের বাঙ্কার, রেডার ক্ষেত্র এবং ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক সরঞ্জাম। উপগ্রহ ও বিমান পর্যবেক্ষণ ক্যামেরায় এসব স্থাপনার ছবি, সেইসাথে হাসপাতাল, খেলাধুলার কেন্দ্র ও বিভিন্নধরনের ভবনের ছবি ধরা পড়েছে। কোন কোন প্রবাল দ্বীপে গড়ে উঠেছে ফল, সব্জি ও পশু খামার। এমনকী একটি প্রবাল দ্বীপের সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্রে চীনা বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিও স্থাপন করা হয়েছে ২০১৯এর জানুয়ারি মাসে। এসব প্রবাল দ্বীপের বাসিন্দারা ফাইভ-জি মোবাইল ডেটার সুবিধা ভোগ করেন। জেলেদের হাতে এখন পৌঁছে গেছে উন্নত মাছ ধরার নৌকা, তাদের জীবন যাপন সেখানে অনেক স্বচ্ছল হয়েছে। এক কথায় দক্ষিণ চীন সাগরের এই দ্বীপগুলোর চেহারা গত ছয় বছরে অনেক বদলে গেছে। আমেরিকা কী করতে চাইছে এসব দ্বীপের উন্নয়নে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ থেকে এটা স্পষ্ট যে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই সমুদ্র এলাকায় চীন তার মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য গত কয়েক বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে এগিয়েছে। সেখান থেকে ফেরা চীনের জন্য এখন একরকম অসম্ভব। আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগরে সম্প্রতি যে নৌ মহড়া চালিয়েছে, তার উদ্দেশ্য, আমেরিকার যুক্তি অনুযায়ী, ছিল আন্তর্জাতিক ওই "সমুদ্রপথের স্বাধীনতা" সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু সম্প্রতি মি. পম্পেও ওই এলাকার ওপর চীনের দাবি "সম্পূর্ণ অবৈধ" বলে আনুষ্ঠানিকভাবে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেই প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটা এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা হল আমেরিকা আগামীতে কী করতে চাইছে। শুধু ওই দ্বীপগুলোর মালিকানার দাবিদার দেশগুলোর সাথে হাত মেলানো নয়, মি. পম্পেও কি চাইছেন তাদের পাশাপাশি আরও বড় শক্তির দেশগুলোকে সাথে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটা কূটনৈতিক জোট গড়তে? সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে চীনের এই নতুন দ্বীপ রাজ্যগুলোকে গুঁড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আমেরিকা অবশ্যই রাখে। কিন্তু তার অর্থ হবে চীনের সাথে সরাসরি যুদ্ধ বাধানো, যেটা চীন এবং আমেরিকা দুজনের কারোর জন্যই বাঞ্ছনীয় হবে না। সূত্র- বিবিসি বাংলা
×