ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টিকতে পারছে না ঢাকায়

মায়ের দীর্ণ চৌকাঠে ফিরছে নিমাইপুত্ররা

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৫ জুলাই ২০২০

মায়ের দীর্ণ চৌকাঠে ফিরছে নিমাইপুত্ররা

মোরসালিন মিজান ॥ মা, মাগো এসেছি আমি! সেই কবে গভীর নিশীথে/তোমার নিমাইপুত্র ঘর ছেড়েছিল, আজ কাশী বৃন্দাবন/তুলোধুনো করে ফের তোর দীর্ণ চৌকাঠে এসেছি...। মায়ের দীর্ণ চৌকাঠে ফিরতে শুরু করেছে নিমাইপুত্ররা। সেই কবে গাঁয়ের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে ঢাকায় চলে আসা! আজ বুঝি ফিরে যাওয়ার সময় হলো। করোনার ঘায়ে টিকতে না পেরে স্বপ্নের শহর ঢাকা ছেড়ে চির আশ্রয় গাঁয়ের পথ ধরেছে তারা। কেউ একেবারেই ছেড়ে যাচ্ছেন। কেউ গাঁয়ে গিয়ে বিপদ কেটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত ঢাকামুখী মানুষ। ঢাকাকেন্দ্রিক প্রায় সবকিছুই। প্রাচীন এ শহর বহু আগে থেকেই নানা সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। শত শত বছর পূর্বে ব্যবসা বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ঢাকা। লাভের আশায় দূরদেশ থেকে বণিকেরা ছুটে এসেছে এখানে। আর ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তো সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদাপ্রাপ্ত হয় ঢাকা। বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৫ সালে করা হয় অসম ও বাংলার রাজধানী। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ঢাকা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী। এ পর্যায়ে এসে প্রায় সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। চাকরি ব্যবসা শিক্ষা চিকিৎসা- কোনটির কথা বলব? সবই প্রায় এখানে। একটু উন্নত সুখী জীবন যাপনের আশায় মানুষ রাজধানীমুখী হয়। কেউ কেউ তো বলেন, ঢাকায় টাকা ওড়ে। লোকে টাকা ধরতে আসে। চাকরি বাকরি ব্যবসা করে বড়লোক হতে আসে। যার যে ক্যারিয়ার, এখানে গড়ে নিতে চায়। এর পর আর গ্রামে ফেরা হয় না। বড় বিপদ দুর্যোগ দুর্বিপাকে না পড়লে গ্রামকে আশ্রয় করে না কেউ। যুগে যুগে কালে কালে দেখা গেছে এমন ছবি। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক দুর্যোগের দিনে মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় গণহত্যা চালায় বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। পরবর্তী দিনগুলোতেও চলে খুন। ধর্ষণ। নির্যাতন। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে মানুষ গ্রামে ফিরতে থাকে। গ্রামে একটু দেরি করে শুরু হয়েছিল নৃশংসতা। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় কোন কোন গ্রামে হানাদাররা যুদ্ধযান নিয়ে পৌঁছতে পারেনি। সেসব গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল শহর ঢাকার মানুষ। নিজের গাঁয়ে, আত্মীয় স্বজন, এমনকি পরিচিত মানুষের গ্রামে গিয়ে লুকিয়েছিলেন তারা। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছেন। না, আজকের ছবিটাকে একাত্তরের মহা ইতিহাসের সঙ্গে মেলানো যাবে না। তবে দুর্যোগটি যে গুরুতর, এ ব্যাপারে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া একমত। বিশ্বজুড়েই চলছে করোনা মহামারী। করোনার মতো এমন ছোবল আগে কেউ দেয়নি। প্রতিটি মানুষ, সবকটি সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত। মারাত্মক অনিশ্চয়তায় পড়েছে। বিনা শব্দে কত কিছু যে ভেঙ্গে পড়ছে। একই কারণে মারাত্মক সঙ্কটে পড়েছে ঢাকার জীবন জীবিকা। বাংলাদেশে সেই ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। অঘোষিত এই লকডাউন টানা দুই মাসের বেশি অব্যাহত ছিল। তার পর ৩১ মে সব খুলে দেয়া হলেও, তা সীমিত পরিসরে। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। স্বপ্নের ঢাকার উল্টো পীঠ দেখতে শুরু করে তারা। দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ কাজ হারায়। কারও কারও বেতন অর্ধেক বা অনিয়মিত হয়ে যায়। ছোটখাটো ব্যবসা ইত্যাদি লাটে ওঠে। যাদের কাজ করলে টাকা, না করলে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরা তারা চোখে শর্ষেফুল দেখতে শুরু করেন। খুব সৌভাগ্যবানরা কিছুটা ধার দেনা করতে পেরেছেন। বাকিরা হাবুডুবু খেতে থাকেন অথৈ সাগরে। বিপদের সময় এই ঢাকায় কে কাকে চেনে? কে দেবে ধার? কেন দেবে? বাড়িওয়ালাদের অঢেল টাকা। চাইলেই ভাড়া মওকুফ করতে পারেন। তা হয়নি। দু’ একটি ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে বাড়িওয়ালারা বরং নিষ্ঠুর হয়েছেন। অমানিবকতার নতুন নতুন নজির গড়েছেন। বাসা থেকে ভাড়াটিয়া বের করে দেয়ার অনেক ঘটনা সামনে এসেছে। মেস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের বই খাতা। এমনকি সনদ। প্রতিবেশীদের মধ্যেও মুখ দেখাদেখি নেই। পাশের বাসায় কে না খেয়ে আছে, কে অসুস্থ হয়ে বিছানায়, খোঁজ নেয়ার সময় হয় না। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা চরমে পৌঁছে। অনেক দিন পর্যন্ত আশা ছিল, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু সে দিন আর আসে না। উল্টো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন বলছে, করোনাকাল আরও দীর্ঘ হবে। কত দীর্ঘ? না সেটিরও কোন আভাস দিতে পারছে না। এর চেয়ে অনিশ্চয়তা আর কী হতে পারে? অঘোষিত লকডাউন তুলে নেয়া হলেও বেসরকারী খাত বিপর্যয়ের মুখে। অসংখ্য মানুষ এখন বেকার। হতাশায় ডুবছে তারা। এই হতাশার শেষ কোথায় কারও জানা নেই। কঠিন এ বাস্তবতায় ঢাকা ছাড়ছে তারা। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি সংগঠন বলছে, এর মধ্যে ৮০ শতাংশ লোক ভাড়া বাসায় থাকেন। সে হিসাবে ঢাকা শহরে ভাড়ায় থাকে এক কোটি ৩৬ লাখ মানুষ। এবার করোনার প্রভাবে এরই মাঝে প্রায় ৫০ হাজার লোক ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে পরিষদ। পরিস্থিতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে অর্থনীতি সমিতিও। গত ৮ জুন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একটি জরিপ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, সাধারণ ছুটি চলাকালীন সময় তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন লোক চাকরি বা উপার্জন হারিয়েছেন। অঘোষিত লকডাউনের আগে দেশে মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৪০ লাখ। ছুটির ৬৬ দিনেই ‘নবদরিদ্র’ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় কোটি ৮০ লাখে। অর্থনীতি সমিতির মতে, সাধারণ ছুটির কারণে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা। সারা দেশে এ ধরনের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৮৬ লাখের বেশি। তাদের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল সাত কোটি ৮০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। সবাই চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। গ্রামে করোনার প্রভাব পড়েনি বা পড়বে না এমন নয়। তবে গ্রামের মাটি জল হাওয়া বড় আপন। অকৃত্রিম। মাঠভরা ধান আর জলভরা দীঘি/চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।/আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন/মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন...। সে আত্মার আত্মীয়দের কাছে মানুষ ফিরছে। আত্মীয় পরিজন প্রতিবেশী সবার সঙ্গে প্রাণ ভরে দুটো কথা তো বলা যায়। জমিতে ধান। পুকুরে মাছ। বাগানে সবজি। তিন বেলা খাওয়া হয়ে যায়। বাসা ভাড়া গুনতে হয় না। অসুস্থ হলে কেউ না কেউ দেখবে, মরলে কাঁদবে, এ আশাও মিথ্যে নয়। এসব কারণে গ্রাম হয়ে উঠেছে পরম আশ্রয়। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে সপরিবারে ঢাকা ছাড়ছে এমন মানুষের সংখ্যা অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই টিকতে না পেরে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। সবারই মন খারাপ। মনে দ্বিধা। ঢাকার আর আসতে পারবেন কিনা জানেন না তারা। কারও কারও আসার ইচ্ছে আছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘আর না। মরলে দেশে গিয়া মরি।’ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কথা হচ্ছিল হাবিবুল্লাহ নামের এক মাঝবয়সীর সঙ্গে। দুঃখ করে তিনি বলছিলেন, ১৩ বছর ঢাকায় ছিলাম। ১৩টা সুহৃদ বানাতে পারিনি। ব্যবসা করতে গিয়ে দুইবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রতারণার শিকার হয়েছি। শেষতক একটি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলাম। করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটন ষোলআনা বন্ধ। প্রতিষ্ঠানও চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে দেরি করেনি। অথচ গ্রাম থেকে আত্মীয়-স্বজন টেনশন করছে। তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য বলছে। সপরিবারে ফিরে যাচ্ছি আমি। আর ঢাকায় ফিরব কিনা জানেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সদরঘাটে কথা হয় শফিউল নামের এক তরুণের সঙ্গে। ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা। করোনায় সব গিলে খেয়েছে। তাই বাড়িতে ফিরে যাওয়া। এ তরুণ বলছিলেন, আমার আগে যারা গ্রামে ফিরেছেন তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তারা বলছে, শহর থেকে লোকজন গ্রামে নাকি করোনা নিয়ে ঢুকছে। সুস্থ মানুষ জানার পরও অনেকে কাছে আসছে না। কথা বলছে না। তাহলে কেন যাচ্ছেন? উত্তরে বলেন, কদিন তো দূরে থাকাই নিয়ম। এর পর ঠিক হয়ে যাবে। নিজের মানুষ না আমরা? কথা শুনে খন্দকার আশরাফ হোসেনের সেই কবিতা মনে পড়ে যায়। যেখানে কবি বলছেন, এ বিশাল পৃথবীতে এ মুহূর্তে অন্য কোনো গন্তব্য তো নেই!/পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ/বাড়ি যাবো, বাড়ি...।
×