ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১৫ জুলাই ২০২০

চলে গেলেন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা শাহজাহান সিরাজ আর নেই। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। আজ বুধবার জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে শাহজাহান সিরাজকে দাফন করা হবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শাহজাহান সিরাজের লাশ নেয়া হয় তার গুলশানের বাড়িতে। আজ বুধবার সকালে টাঙ্গাইলের নিজ বাড়িতে নেয়া হবে মরদেহ। সেখানে এলেঙ্গায় একটি এবং কালিহাতীতে একটি জানাজা হবে। এরপর কফিন ঢাকায় আনার পর এশার নামাজ শেষে গুলশান সোসাইটি মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে শাহজাহান সিরাজকে। মৃত্যুকালে শাহজাহান সিরাজ স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ, মেয়ে সারোয়াত সিরাজ ও ছেলে রাজীব সিরাজসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ ও মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। সোমবার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১২ সালে তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর কয়েক বছর পর ক্যান্সার ধরা পড়ে মস্তিষ্কেও। তখন থেকেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনি। শাহজাহান সিরাজের মৃত্যু সংবাদ শুনে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যু সংবাদ শোনার পর স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তার মৃত্যুতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে। বিএনপির পক্ষে শোক জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদন প্রকাশ করেন। শাহজাহান সিরাজ ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আব্দুল গণি মিয়া ও মা রহিমা বেগম। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে শাহজাহান সিরাজ ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সে সময় তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র ছিলেন। এরপর তিনি ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে উঠে আসেন। ১৯৬৪-৬৫ এবং ১৯৬৬-৬৭ দুই মেয়াদে তিনি করটিয়া সা’দাত কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। এরপর তিনি ১৯৭০-৭২ মেয়াদে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন শাহজাহান সিরাজ। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ‘নিউক্লিয়াস’ এর সক্রিয় কর্মী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা। শাহজাহান সিরাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ‘চার খলিফা’ বলা হতো শাহজাহান সিরাজ ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রবসহ অন্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। সেখান থেকেই পরদিন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল এক ছাত্রসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন শাহজাহান সিরাজ। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শাহজাহান সিরাজ সর্বদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। রব-সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন থেকে জাসদ গঠিত হলে সেই দলের প্রতিষ্ঠাতাসহ সাধারণ সম্পাদক হন শাহজাহান সিরাজ। তখন তাকে কিছু দিন কারাগারেও থাকতে হয়েছিল। পরে জাসদের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। জাসদ কয়েকটি ভাগ হলে একটি অংশের হাল ধরেন শাহজাহান সিরাজ। প্রথম এইচএম এরশাদের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে রবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আলাদা হয়ে যান শাহজাহান সিরাজ। তখন শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তবে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে শাহজাহান সিরাজের অংশগ্রহণ নিয়ে দ্বন্দ্বে ইনু আলাদা জাসদ পড়লে একা হয়ে পড়েন তিনি। এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী সাবেক ছাত্রনেত্রী রাবেয়া সিরাজের সঙ্গে ১৯৭২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শাহজাহান সিরাজ। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তার স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ একজন শিক্ষিকা এবং রাজনীতিবিদ। জাসদের মনোনয়নে তিনবার তিনি জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে প্রথম, ১৯৮৬ সালে এবং ১৯৮৮ সালে তৃতীয়বার জাতীয় সংসদে জাসদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আর বিএনপির মনোনয়নে ২০০১ সালে চতুর্থবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপি থেকে। ১৯৯৫ সালে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। একপর্যায়ে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। তবে তিনি দলটির বর্তমান কমিটিতে নেই। তাঁর স্ত্রী বেগম রাবেয়া সিরাজ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে প্রথমে ওই সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ওই সরকারের শেষ দিকে তিনি নৌপরিবহনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থা জারির পর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার হন শাহজাহান সিরাজ। তখন দুর্নীতির মামলায় তার সাজা হয় কিছুদিন কারাগারে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে চার খলিফার একজন জাসদ (একাংশ) সভাপতি আসম আবদুর রব শাহজাহান সিরাজের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণের অন্যতম কারিগর। মুক্তিযুদ্ধের বীর সিপাহসালার শাহজাহান সিরাজ আমাদের জাতির অস্তিত্বের অংশ। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অসম সাহসিকতা ও সংগ্রামী হিসাবে ছাত্র-যবসমাজকে সংগঠিত ও তাদের মাঝে স্বাধীনতার মন্ত্র ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। আসম রব বলেন, ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিশাল জনসভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচী প্রকাশ করা হয়। যৌবনের বহু সোনালি দিন শাহজাহান সিরাজ দেশমাতৃকার জন্য কারাগারে কাটিয়েছেন। শাহজাহান সিরাজ আমার আন্দোলন সংগ্রামের সাথী, আমার অনুভূতি আমার চেতনার অংশ। তাঁর মৃত্যু দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। যতদিন আমাদের স্বাধীনতা, জাতির অস্তিত্ব, পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত থাকবে ততদিন শাহজাহান সিরাজ বেঁচে থাকবেন সকল বাঙ্গালীর হৃদয়ে।
×