ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারী হাসপাতাল

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১৫ জুলাই ২০২০

নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারী হাসপাতাল

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ ময়মনসিংহে সরকারী হাসপাতালের পাশে গড়ে ওঠা দালাল নির্ভর বেশিরভাগ বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বাস্থ্য সেবার নামে ‘টাকা কামানোর’ নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চলছে কাটা ছেড়ার ব্যবসা! প্রয়োজন নেই, তারপরও কেবল মোটা অঙ্কের টাকার জন্য এপেনডিক্স ও সিজারের মতো অপারেশন করা হচ্ছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবে সেবার চিত্র আরও ভয়ঙ্কর। অভিযোগ : রক্ত ও মল মূত্রের নমুনা সংগ্রহের পর বালতি কিংবা বাথরুমে ফেলে দিয়ে রোগীকে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে টেস্টের রিপোর্ট। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ও পরিবেশের ছাড়পত্রসহ নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই অধিকাংশ হাসপাতালের। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাবের নামে বেনামে মালিক হচ্ছেন সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী সাবেক দালাল। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কর্মচারীদের সহায়তায় রোগী ভাগিয়ে বেতনভুক্ত দালালরা নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারী হাসপাতাল ও ল্যাবে। আরও অভিযোগ, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরাই এসব হাসপাতাল ও ল্যাবের চেম্বারে রোগী দেখছেন। শুধু কমিশনের জন্য তারা টেস্টের জন্য রোগীকে ওই ল্যাবে টেস্টের পরামর্শ দিচ্ছেন। বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ল্যাবে ভুয়া মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। নামকরা অনেক ল্যাবকে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারের অভিযোগে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে গুনতে হয়েছে মোটা অঙ্কের জরিমানা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মতিউর রহমান ভুইয়া জানান, স্বাস্থ্য সেবায় এমন নৈরাজ্য কাম্য নয়। বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহের সভাপতি ডাঃ হরিশঙ্কর দাস জানান এসব দেখার দায়িত্ব স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান শামীম জানান, বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তাদের ‘ঠুটো জগন্নাথ’ ভূমিকার কারণেই বেপরোয়া স্বাস্থ্য খাত। বেসরকারী হাসপাতাল অনুমোদন দেয়া হয়। প্রচার রয়েছে, খোঁজ না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ফলে নিয়ম নীতির কোন তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বেসরকারী হাসপাতাল ল্যাব। ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডাঃ এবিএম মশিউল আলম অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, ইতোমধ্যে বেসরকারী হাসপাতাল ও ল্যাব মালিকদের রেজিস্ট্রেশন হালনাগাদসহ বিদ্যমান আইন মেনে চলতে পত্র দেয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাবে অভিযান পরিচালনা হবে। অভিযানের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে সায়েম ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান জানান, তাদের মতো বড় বড় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক বেশিরভাগ নিয়ম মেনে চলছে। আর যারা আইন ভেঙ্গে কেবল সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ব্যবসা করছে তাদের হাসপাতাল ল্যাবে কখনও অভিযান হচ্ছে না। পপুলার ডায়াগনস্টিকের ম্যানেজার নূর ইসলাম জানান, নিয়ম মানতে বাধ্য করা হলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে এ ধরনের বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ল্যাব। ল্যাব এইড, ময়মনসিংহ শাখার ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ খন্দকার বাকী বিল্লাহ জানান, রোগ নির্ণয় ও মানসম্পন্ন একটি রিপোর্টের জন্য স্যাম্পল কালেকশন থেকে শুরু করে নির্ধারিত তাপমাত্রায় ল্যাবে পরীক্ষার জন্য মানসম্পন্ন মেশিন, রি-এজেন্ট, ডিপ্লোমা পাস টেকনিশিয়ান ও ডিগ্রীধারী প্যাথলজিস্ট অত্যাবশ্যক। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের জারি করা পরিপত্রে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকসহ ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনায় অনলাইনে আবেদন করে অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনলাইন আবেদনে নির্ধারিত ফির সঙ্গে পরিবেশের ছাড়পত্রসহ নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্যাথেডিন মরফিন জাতীয় মাদকদ্রব্য ব্যবহারের অনুমতিপত্র, ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিপত্র, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও কলকারখানা পরিদফতরের অনুমতিপত্র নেয়ার শর্ত রয়েছে। বেসরকারী হাসপাতালের জন্য জায়গা অনুপাতে বেড, আর বেড অনুপাতে চিকিৎসক ও ডিগ্রীধারী নার্স থাকা বাধ্যতামূলক। একইভাবে ল্যাব-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জন্য রেজিস্টার্ড প্যাথলজিস্ট ও ডিপ্লোমা পাস টেকনিশিয়ান থাকা বাধ্যতামূলক। হাতে গোনা ৫/৬টি ছাড়া ময়মনসিংহের বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিক ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসব শর্ত পূরণ করতে না পারায় অনলাইনে আবেদনই করতে পারছে না। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশে ৫০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই আইন ভঙ্গ করে গড়ে উঠেছে বেসরকারী সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব। এমনকি সরকারী হাসপাতালের সামনে ২০০-৫০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে শতাধিক বেসরকারী হাসপাতাল ও ল্যাব। ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডাঃ এবিএম মশিউল আলম জানান, সরকারী হাসপাতালের এক কিলোমিটার এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোন বেসরকারী হাসপাতাল থাকতে পারবে না। অথচ এই আইন মানা হচ্ছে না। চরপাড়া প্রাইমারী স্কুলের গলি, বাঘমারা, ভাটিকাশর ও ব্রাহ্মপল্লীর অলিগলিতে গড়ে ওঠা প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকে নেই কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও নার্স। অভিযোগ রয়েছে, রাত ১২টার পর এসব এলাকার হাসপাতাল ও ক্লিনিকে শিক্ষানবিস চিকিৎসক, এনেসথেসিস ও নকল নার্স দিয়ে চলে প্রসূতির সিজার ও এপেনডিক্সসহ নানা অপারেশন। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ তায়েবা মীর্জা তানজিলা জানান, বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে আসা বেশিরভাগ রোগীর সেলাই নি¤œমানের সুতার। অনেক হাসপাতাল ক্লিনিকে অটোক্লেভ নেই। ফলে সহজেই সেলাই খুলে ইনফেকশন হচ্ছে। অবস্থা খারাপ হলেই পাঠানো হচ্ছে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে। অনেক ক্ষেত্রে নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। মালিক কারা ॥ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ও শেয়ার হোল্ডার সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারী হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক রোগী দেখেন তাদের অনেকেরই চেম্বার রয়েছে এসব বেসরকারী হাসপাতাল ও ল্যাবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারী হাসপাতালের বিশেষ কিছু বিভাগ থেকেই সবচেয়ে বেশি রোগীকে টেস্টের জন্য বেসরকারী হাসপাতাল ও ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে। নামীদামী হাসপাতাল ও ল্যাবগুলো একশ্রেণীর চিকিৎসকদের অগ্রিম কমিশন দেয়ার রেওয়াজ চালু করেছে। তবে মধ্যম সারির ল্যাব এই কমিশন নগদ পৌঁছে দিচ্ছে। এতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজের আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য ল্যাবে বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলেও রোগীদের বাইরের এসব ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে। ফলে একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে রোগীদের। রোগীরা আস্থা হারাচ্ছে সরকারী হাসপাতালের ওপর। স্থানীয় এক ল্যাব মালিক মঞ্জুরুল হক জানান, ডিগ্রীধারী চিকিৎসক দিয়ে নির্ভুল রিপোর্ট দেয়া হলেও ময়মনসিংহ মেডিক্যালের একশ্রেণীর চিকিৎসক নির্ধারিত ল্যাবের বাইরের কোন রিপোর্ট গ্রহণ করছে না। কোন ক্লিনিক ল্যাবের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার না থাকায় নিয়ম নীতি না মেনেই সবকিছু চলছে বলে অকপটে স্বীকার করেন ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডাঃ এবিএম মশিউল আলম। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালত মানহীন হাসপাতাল বন্ধসহ সিলগালা করে দেয়ার পরও সিলগালা খুলে সেটি পরিচালনার করার নজির রয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন! জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্যমতে খোদ ময়মনসিংহ শহরে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব প্রায় ২০০। কিন্তু বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা কমপক্ষে ৩০০। সরকারী তালিকায় যেসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব রয়েছে তাদের বেশিরভাগ বছরের পর বছর ধরে নবায়ন করছে না। হাসপাতাল পরিচালনার অনুমোদন নিয়ে অনেকে ল্যাব খুলে বসেছে। এছাড়া এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবে নেই কোন ডিপ্লোমাধারী নার্স ও প্রশিক্ষিত আয়া। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক দেখানো হয় কেবল খাতায়! আয়াদের নার্সের পোশাক পরিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করা হচ্ছে। অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবে নকল নার্সদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে। ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে হাসপাতাল ল্যাব ॥ নগরীর সারদা ঘোষ রোডের মোটামুটি পরিচিত একটি হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। পরিবেশ অধিদফতর, মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ, কলকারখানা পরিদফতর, পরমাণু শক্তি কমিশনসহ অন লাইন আবেদনের শর্তে প্রয়োজনীয় কোন ছাড়পত্র নেই! নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন মেলার আগে থেকে চলছে স্বাস্থ্য সেবার এই প্রতিষ্ঠান। আলোচ্য হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, সবাই চালাচ্ছে- আমরাও পরিচালনা করছি এভাবে। এসব হাসপাতালের ‘অনলাইন’ কোন অনুমোদন নেই। বেশির ভাগ হাসপাতালে নেই সার্বক্ষণিক রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও ডিপ্লোমা পাস নার্স। নেই মানসম্পন্ন অপারেশন থিয়েটার ও অপারেশন থিয়েটারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। একই অবস্থা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর। মানসম্পন্ন ল্যাব নেই অনেকের। নেই প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ। প্যাথলজিস্ট ও টেকনিশিয়ানও নেই। বাসা বাড়ির ফ্রিজ ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক ল্যাবে। ফলে তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় রি-এজেন্টের কার্যকারিতা থাকছে না। অথচ এই ডোমেস্টিক ফ্রিজে সংরক্ষণ করা রি-এজেন্ট দিয়েই চলছে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা।
×