ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ২২:৫০, ১৪ জুলাই ২০২০

উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দেশের সব প্রধান নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এ কারণে বন্যার অবনতির সঙ্গে সঙ্গে এর বিস্তৃতিও বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত। দুএকদিনের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে পারে। প্রথম দফা বন্যার ক্ষত না সারতেই দ্বিতীয় ধাপের এ বন্যায় লাখো মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। গত সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় দুর্গতদের অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে আবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তিস্তার পাড়ের মানুষ নদীর এমন ভয়াবহ রূপ কখনও দেখেনি। ডালিয়া পয়েন্টে নদীটির পানি বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সোমবার থেকে। এর আগে রবিবার রাতে ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এদিকে দ্বিতীয় দফায় বন্যা কবলিত এলাকায় লাখ লাখ মানুষ নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। তাদের ঘরবাড়ি এখন পানির নিচে। ফলে বন্যার্তদের দুর্ভোগের কোন শেষ নেই। এই অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড আভাস দিয়েছে আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের সব প্রধান নদীর পানি অব্য্হাতভাবে বাড়বে। তাদের হিসাব মতে, সোমবার দেশের ১৪টি নদীর পানি ২২ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। তারা জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সুরমা ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকায় প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতলে বৃদ্ধি পেতে পারে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী আরিচা পয়েন্টে, পদ্মা নদী ভাগ্যকূল ও মাওয়া পয়েন্টে এবং কুশিয়ারা নদী শেরপুর পয়েন্ট বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। তবে এ সময়ে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে। এ কারণে ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অপরদিকে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজবাড়ী জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এদিকে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ফেনী জেলার বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। দেশের পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৮টির, হ্রাস পেয়েছে ২০টির, অপরিবর্তিত রয়েছে ৩টির। এর মধ্যে বিপদসীমার ওপরে ২২টির। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে লালাখাল ১৬০ মিলিমিটার, পঞ্চগড় ১৪৮, নোয়াখালী ১১৭ মিলিমিটার, টেকনাফ ১০৪ মিলিমিটার, ঠাকুরগাঁও ৯১ মিলিমিটার, জাফলং ৮৭ মিলিমিটার, সিলেট ৮৫ মিলিমিটার, ডালিয়া ৮২ মিলিমিটার, ছাতক ৮০ মিলিমিটার, দিনাজপুর ৭৮ মিলিমিটার। নীলফামারী ॥ সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ। সোমবার সকাল ছয়টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রবিবার রাত ১২টায় সেখানে পানি প্রবাহ ছিল বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপরে। এ সময় তিস্তা ব্যারাজসহ আশপাশ এলাকায় রেড এলার্ট জারি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরপর পানি কমতে শুরু করলে সোমবার সকাল নয়টায় ওই রেড এলার্ট প্রত্যাহার করা হয়। উজানের ঢলে তিস্তার পানি বিপদসীমার অতিক্রম করে গত শুক্রবার। সে থেকে বিপদসীমার ওপরে চলছে পানি প্রবাহ। টানা চার দিনের ঢলে জেলার ডিমলা উপজেলার নদী বেষ্টিত পূর্বছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপনী, পশ্চিমছাতনাই, গয়াবাড়ি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। এসব পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করে চরম ভোগান্তিতে পড়ে অনেকে আশ্রয় নেয় বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে। এদিকে তিস্তা রুদ্রমূর্তি ধারণ করায় এলাকাবাসী বলছে বাপ দাদার মুখত (মুখে) শুনিছিনু (শুনেছি) তিস্তা নাকি রাক্ষুসে। তামাম (সকল) জমি খায়া (খেয়ে) ফেলাইছে। এইবার নিজ চোখে দেখিনু তিস্তা হাচায় রাক্ষুসী। তিস্তার চার দিনের বন্যায় পানিবন্দী হয়ে অসহায়ত্বের কথাগুলো বলেন, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ছোটখাতা সুপারিটারীর গ্রামের বিধবা আমিনা খাতুন (৬০)। কুড়িগ্রাম ॥ টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৫ শতাধিক গ্রামের প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ধরলা নদীর পানির প্রবল চাপে সদর উপজেলার সারডোবে একটি বিকল্প বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে গবাদীপশু নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছে। ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম জানান, আমার ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে বীজতলার। এই পানি বেশি দিন অবস্থান করলে বীজতলাসহ বন্যাকবলিতরা খাদ্য সমস্যায় ভুগবে। এই মুহূর্তে বন্যা কবলিতদের উদ্ধারসহ ত্রাণ সহায়তা দরকার। গাইবান্ধা ॥ উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢল এবং ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সব নদীর পানি এখন বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি নতুন করে আবার বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী নিচু অঞ্চল এবং বিভিন্ন চর এলাকায় নতুন করে পানি উঠতে শুরু করেছে। মানুষ আবারও বন্যা আতঙ্কে নানা উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। এদিকে পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট হুমকির মুখে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও টানা বর্ষণে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে দ্বিতীয় বারের মতো পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এদিকে যমুনায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবারও প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। দ্বিতীয় দফায় তলিয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের ফসলি জমি। পানি উঠতে শুরু করেছে নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে। আবারও বন্যা কবলিত হয়ে পড়ছে জেলার ৫টি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের মানুষ। ইতোমধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করায় ভয়াবহ বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে। বগুড়া ॥ সারিয়াকান্দিতে যমুনা পয়েন্টে প্রতি মুহূর্তে পানি বাড়ছে। পানিবন্দি প্রায় এক লাখ মানুষ। পাহাড়ী ঢলের পানি ও টানা বৃষ্টিপাতে দক্ষিণের শেরপুরে উপজেলার পৌর এলাকার তিনটি ওয়ার্ড জলমগ্ন হয়েছে। বড় বন্যা ছাড়া শেরপুরে সাধারণত পানি ঢোকে না। এই অবস্থান পাউবো মনে করছে আগামী ৩৬ ঘণ্টায় বগুড়ার আরও অনেক এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে বড় বন্যার দিকে এগিয়ে যাবে। তাদের আশঙ্কা বগুড়া অঞ্চলকে জুলাই মাসজুড়ে বন্যার ধাক্কা সামলাতে হবে। সুনামগঞ্জ ॥ ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে ২য় দফায় সৃষ্ট বন্যা সুনামগঞ্জে পরিস্থিতি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যায় জেলার ৮৭ ইউনিয়নের ৮৩ ইউনিয়নের মানুষ এখন পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। সড়কে ভাঙ্গন ও রাস্তা তলিয়ে যাওয়ার ফলে জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভররপুর উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে আজও। প্রথম ধাপের বন্যার ভোগান্তি শেষ না হতেই ফের বন্যায় কবলিত হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ১১ উপজেলার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। অভোক্ত মানুষগুলো নিজের খাবারের পাশপাশি দুচিন্তায় আছেন গবাদিপশু-পাখি নিয়েও। নেত্রকোনা ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় নেত্রকোনা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। কলমাকান্দা ও খালিয়াজুরীর পর দুর্গাপুর, মদন এবং মোহনগঞ্জ উপজেলারও কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাঁচ উপজেলায় প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা প্রায় দেড় শ’। পাহাড়ী ঢলের তোড়ে দুর্গাপুরের গাওকান্দিয়া ইউনিয়নের বন্দ-উষাণ গ্রাম সংলগ্ন একটি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদী এবং খালিয়াজুরীর হাওড় পাড়ে ঢেউয়ের ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। তবে রবিবার রাত থেকে বৃষ্টিপাত কমেছে। ফেনী ॥ ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ী পানির ঢলে ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর মুহুরী ও কহুয়া নদীর বাঁধের ৮টি পয়েন্টে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গনের কারণে ফুলগাজীর ৭টি ও পরশুরামের ৬টিসহ ১৩টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সোমবার দুপুর ১২টায় মুহুরী নদীর পানি পরশুরাম পয়েন্টে বিপদসীমার এক মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরশুরাম উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন জানান, বন্যার পানিতে ফসলির জমির পাশাপাশি মৎস্য খামারের ৬০/৭০ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, অনেক কাঁচাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষার পিক আওয়ারে ভারতীয় ঢলের পানি মুহুরী নদী দিয়ে সাগরে যায় ফলে পানির তীব্রতা বেড়ে যায়। মুহুরী ও কহুয়া আগে সত্যকারে নদী ছিল। বর্তমানে নদীগুলো সঙ্কোচিত হয়ে গেছে। নদীগুলো এখন পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। গত ২ বছরে এ এলাকায় ৭ বার বন্যা হয়েছে।
×