ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পালাতে পারবে না সাহেদ ধরা পড়তেই হবে ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশিত: ২২:২৩, ১৩ জুলাই ২০২০

পালাতে পারবে না সাহেদ ধরা পড়তেই হবে ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আবারও নিশ্চিত করেছেন- সাহেদ পালাতে পারবে না। তাকে ধরা পড়তেই হবে- নয় আত্মসমর্পণ করতে হবে। বিদেশে পালানোরও সুযোগ নেই। রবিবার দুপুরে ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন-সাহেদ কোথায় সেটা সাহেদ জানে। তারও উচিত আত্মসমর্পণ করা। সাহেদকে র্যােব-পুলিশ খুঁজছে। আশা করি, খুব শীঘ্রই তার গ্রেফতারের বিষয়টি আপনাদের জানাতে পারব। সে কী ধরনের অন্যায় করেছে, সেগুলো ইনকোয়ারি করছে। রিপোর্ট এলে আপনাদের জানাতে পারব। তার অন্যায়ের গভীরতাটা কতটুকু। উত্তরা থানা সবসময় সাহেদকে শেল্টার দিয়েছে এগুলো আপনারা আমলে নিচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়টি উদঘাটনের পর কেউ তাকে শেল্টার দেয়নি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তার অপরাধ বের করেছে। সে কী করেছে সেগুলো র্যা ব ও পুলিশ তদন্ত করছে। তাকে অবশ্যই আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশের বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নাই। তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে, বর্ডার যাতে ক্রস করতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা খুঁজছি। আশা করি, শীঘ্রই তাকে ধরতে সক্ষম হব। এ সভায় কোরবানির পশুর হাটের নিরাপত্তা ও চামড়া পাচার রোধ এবং শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা হয়। সভায় আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, সাহেদ গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চলবে। এ নিয়ে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। সরকারী হাসপাতাল থেকে যেভাবে রোগী ভাগিয়ে নিতেন সাহেদ ॥ শুধু করোনা নয়- সরকারী সব হাসপাতাল থেকে অন্যান্য সব ধরনের রোগী ভাগিয়ে আনতেন নিজের হাসপাতালে। এ জন্য শ্রেণীবদ্ধ এজেন্ট পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের কাজ ছিল রাজধানীর সরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী আনা। যদি এ নিয়ে বিরোধ দেখা দিত- তাহলে ভুক্তভোগীকে মিথ্যা মামলা দেয়া হতো। ক’জন নারীকেও ব্যবহার করা হতো থানা পুলিশকে ম্যানেজ করার জন্য। রিমান্ডে থাকা একজন দালালের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এ ধরনের তথ্য। তাদের একজন রয়েছে রিমান্ডে। পুলিশ জানিয়েছে, এ ধরনের কা-ে সহযোগিতা করত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় সদস্যরা। হাসপাতালের নানা অনিয়ম টিকিয়ে রাখতে থানা পুলিশকে প্রতিমাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে মাসোহারা দিয়ে আসছিল রিজেন্ট গ্রুপ। উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতালে নানা অজুহাতে প্রায় অর্ধশত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মারধর করে বিভিন্ন ধরনের মামলা দিয়ে চাকরিচ্যুত করেছেন। আবার কারোর কাছ থেকে অর্থও আদায় করত সাহেদ। আর এসব অপকর্ম করতে সাহেদ ব্যবহার করত কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও কিছু গণমাধ্যম কর্মীকে। তাছাড়া হাসপাতালের ভবনের ভাড়া পরিশোধ করা হতো না। ২০১০ সালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের ৩৮ নম্বর বাড়ি ভাড়া নিয়ে রিজেন্ট হসপিটাল গড়ে তোলেন। এই বাড়ির মালিক সেনাবাহিনীর সাবেক এক মেজর। তিনি বারিধারা ডিওএইচএসে থাকেন। শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ কথা রাখেনি। মাসিক ভাড়া ছিল ৭৬ হাজার টাকা। কিন্তু নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা হতো না। এই নিয়ে মালিকের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। এখনও বাড়ির মালিক প্রায় ১৬ লাখ টাকা পাবেন। টাকা চাইলে তাকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হতো। মালিককে রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে কাবু করে রাখতেন সাহেদ। হাসপাতালের রোগী ভাগাতে ঢাকাসহ আশপাশে নামীদামী হাসপাতালগুলোকে টার্গেট করতেন। আর এই কারণে দালাল নিয়োগ করতেন প্রায় হাসপাতালেই। পাশাপাশি রিজেন্ট হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরও রোগী ভাগিয়ে আনার দায়িত্ব ছিল। তাছাড়া ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো থেকেও রোগী ভাগিয়ে আনা হতো। নির্দিষ্টহারে রোগী ভাগিয়ে আনতে না পারলে নারী দিয়ে ধর্ষণসহ অন্যান্য মামলা দিয়ে নির্যাতন চালাতেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন সাহেদ। তার ভয়ে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিজেন্ট হাসপাতালের এক চিকিসৎক জানান, ঢাকায় যত নামী-দামী হাসপাতাল ছিল সেখান থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা হয়। বিশেষ করে ঢাকা মেডিক্যাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, ল্যাবএইড হসপিটাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতাল, সৈয়দ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতাল, ইবনে সিনা হসপিটাল, টঙ্গি সরকারী হাসপাতাল, গাজীপুর তাজউদ্দিন সরকারী হাসপাতাল, ময়মনসিংহ সরকারী হাসপাতাল, কুমিল্লা সরকারী হাসপাতাল, জামালপুর সরকারী হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা হচ্ছে। এই জন্য ওইসব হাসপাতালের কতিপয় কর্মকর্তাকে নিয়মিত অর্থ দিত। বছরখানেক আগে ২ প্রশাসনিক কর্মকর্তার টঙ্গি ও ময়মনসিংহ হাসপাতাল থেকে ১০ জন রোগী আনার কথা ছিল। কিন্তু তারা আনতে পারেননি। আর এই কারণে ওই কর্মকর্তাদের মারধর করে নারী দিয়ে ধর্ষণের মামলা ঠুকে দেয় টঙ্গি থানায়। এমনকি আমার বিরদ্ধেও মামলা দিতে চেয়েছিল। আমার বেতন দেয়ার কথা ছিল ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু এক মাস পরেই সাহেদ আমাকে জানায়, আপনার বেতন হবে ২০ হাজার টাকা। প্রতিবাদ করলে অশ্লীলভাষায় গালাগাল করে তিনি আমার গালে থাপ্পর মেরে বসেন। পরে আমি চাকরি ছেড়ে দেই। উত্তরা ও মিরপুরে ২টি হসপিটালেই চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর নির্যাতন করে। আমার জানামতে, অন্তত অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। অনেকে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছে। গত ডিসেম্বরে টঙ্গি সরকারী হাসপাতালের এক ডাক্তার রিজেন্ট হাসপাতালে রোগী না দেয়ায় নারী নির্যাতন মামলা করে সাহেদ। পরে ওই ডাক্তার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালে সাহেদ মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। এ বিষয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের সাবেক কর্মকর্তা সোহাগ বলেন, এমন কোন অপকর্র্ম নেই যে সাহেদ করেনি। তার সঙ্গে প্রায় ৪ বছর চাকরি করেছি। তার অনেক অপকর্ম নিজ চোখে দেখেছি। হাসপাতালটি ব্যবহার করে সে নানা কায়দায় প্রতারণা করেছে। বিভিন্ন নামী হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা হতো। আর না আনতে পারলেই সুন্দরী নারীদের দিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে নানাভাবে হয়রানি চালাত। সবাইকে প্রশাসনের ভয় দেখাত। তিনি আরও বলেন, মিরপুর ও উত্তরায় অন্তত দুই ডজন তরুণীকে সাহেদ লালন পালন করে। তাদের নিয়ে সাহেদসহ তার সাঙ্গপাঙ্গরা আনন্দ ফুর্তি করে। কয়েক বছর আগে তার কথামতো রোগী আনতে না পারায় আমাকে মারধর করে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি প্রতারণা মামলা দেয় আমাকেসহ পরিবারের ৫ সদস্যর নামে। আমি নাকি তার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা আত্মসাত করেছি। প্রথমে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পরে পুলিশ সদর দফতরের একজন এডিশনাল আইজিপির নির্দেশে পুলিশ মামলা নেয়। আমার মতো অনেকের নামে সাহেদ মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। নারীদের মধ্যে মুমু ও মাইজিয়া ইসলাম মৌ বেশি নাজেহাল করেছে সবাইকে। এই রকম হাজারও অভিযোগ আছে সাহেদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মোঃ আশিক বিল্লাহ জানান, রিজেন্ট চেয়ারম্যান সাহেদের নানা প্রতারণার তথ্য প্রতিদিনই পাচ্ছি। যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের অভিযোগ পাচ্ছি। সাহেদকে ধরতে নজরদারি কয়েক ধাপ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আশা করি খুব দ্রুতই তাকে ধরা সম্ভব হবে। এদিকে র্যাহব জানিয়েছে, সাহেদ আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তিনি দেশেই আছেন। বিদেশে পালিয়ে যেতে পারবেন না। পুলিশ ও র্যা ব অনুসন্ধান করছে। তার স্বজন ও পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তাছাড়াও গ্রেফতার হওয়া তার সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতারক সাহেদ করিম বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ছবি তুলতেন। এসব ছবি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গাতে ব্যবহার করে অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ ও প্রতারণা করতেন। এছাড়াও তিনি হাসপাতালের স্টাফদের নিজের কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন করতেন। তদন্তকারী দলের এক কর্মকর্তা জানান, সাহেদ দেশত্যাগ করতে পারে, এমন শঙ্কা ছিল। রিমান্ডে থাকা আসামিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার রাতে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হয় রিজেন্ট হাসপাতালে। সেখান থেকে সাহেদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। এখন অন্তত সাহেদ কোন এয়ারপোর্ট বা বন্দর হয়ে দেশত্যাগ করতে পারবেন না। অভিযানকালে আমরা রিজেন্ট কার্যালয়ের রান্নাঘর থেকে কম্পিউটারের তিনটি হার্ডডিস্ক জব্দ করেছি। এর মধ্যে সাহেদের ল্যাপটপের হার্ডডিস্কও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ধরা পড়ার শঙ্কায় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি গায়েব করার উদ্দেশে হার্ডডিস্কগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমরা হার্ডডিস্ক বিশ্লেষণ করব, ফাইল ডিলিট করা হলে সেগুলো উদ্ধার করে খতিয়ে দেখা হবে। বালু-পাথরের ব্যবসা করতে গিয়েও প্রতারণা করেছেন সাহেদ। সেই অর্থ প্রতারণার দায়ে মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সিলেটের জৈন্তাপুরের ব্যবসায়ী শামসুল মাওলার কাছ থেকে ৩২ লাখ টাকার মালামাল নেয়ার পর পরিশোধ করেন মাত্র ২ লাখ। বাকি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য চেক দেন। কিন্তু ব্যাংকে চেক বাউন্স হওয়ার পর ওই ব্যবসায়ী মামলা দায়ের করেছেন। সেটিও তদন্ত চলছিল। এরকম অর্ধশত ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ আমরা আমলে নিচ্ছি। উল্লেখ্য গত সোমবার নানা অনিয়ম, প্রতারণা, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ ও করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট ও সার্টিফিকেট দেয়া ও রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপের দুটি হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যা বের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন র্যােবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।
×