ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঔষধি গুণসম্পন্ন সুস্বাদু পুষ্টিকর-অর্থকরী ফল ড্রাগন

প্রকাশিত: ২১:৫২, ১৩ জুলাই ২০২০

ঔষধি গুণসম্পন্ন সুস্বাদু পুষ্টিকর-অর্থকরী ফল ড্রাগন

এ রহমান মুকুল ॥ পঞ্চগড়ে কমলা, স্ট্রবেরি ও চায়ের পর বিদেশে রফতানিযোগ্য অত্যন্ত সুস্বাদু, অধিক পুষ্টি ও ঔষধিগুণ অর্থকরী ফল ড্রাগনের বাণিজ্য-সফল আবাদ এবার বদলে দিল পঞ্চগড়ের দৃশ্যপট। সাফল্যের পর নতুন মাত্রায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি পুষ্টি ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ ড্রাগন ফল চাষ। শুরুটা শখের বসে হলেও সাফল্যের পর এখন বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে ড্রাগন বাগান। দুই একর (ছয় বিঘা) জমিতে চারা রোপণের দুই বছরের মধ্যে ড্রাগন ফল বাজারজাত শুরু হয়। তিন বছরেই সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। ঢাকার কাওরান বাজারে ফল পাইকারি ৩শ’ টাকা প্রতিকেজি বিক্রি করা হচ্ছে। তবে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা আসতে না পারায় গত বছরের চেয়ে এ বছর ১ থেকে দেড় শ’ টাকা কমে প্রতিকেজি ফল বিক্রি করতে হচ্ছে। যা গত বছর ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা কেজি দরে বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা বাগান থেকেই ফল সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। জেলার বোদা উপজেলার বোদা-মাড়েয়া পাকাসড়ক সংলগ্ন নয়াদিঘী এলাকায় স্থাপিত ড্রাগন ফল বাগানটি হয়ে উঠেছে একটি দর্শনীয় স্থান। ওই এলাকাটির নামটিও বদলে হয়েছে ড্রাগন গ্রাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালেও বিদেশী এই ফলের বাগান দেখতে জেলার নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য মানুষ। পঞ্চগড়ে ড্রাগন চাষের উদ্যোক্তা রাসেদ প্রধান জানান, প্রথমে তিনি শখের বসে অল্পকিছু জমিতে থাইল্যান্ড জাতের ড্রাগন চারা রোপণ করেন। এতে বেশ সাফল্য পাওয়ায় এখন তার দুই একর জমির ওপর ড্রাগন ফল বাগান হয়েছে। বাগানে তার ৪ হাজার গাছ রয়েছে। আরও বাগান সম্প্রসারণের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন। যে দুই একর জমিতে তিনি ড্রাগন ফল বাগান করেছেন, বাগানের প্রতিটি গাছে ফল ধরেছে। গত বছর প্রথম অল্প কিছু ফল ধরলেও চলতি মৌসুমে তার এই দুই একরে ইতোমধ্যে তিন হাজার কেজি ফল বিক্রি করেছেন তিনি। বাগানে যে ফুল ও ফল আছে তাতে আরও আট হাজার কেজি ফল পাওয়ার আশা করছেন। বাজারমূল্য ভাল পেলে এ বছরই তিনি ৩০ লাখ টাকা আয় করতে পারবেন। আগামী বছর ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার ফল পাওয়ার আশা করছেন। তরুণ উদ্যোক্তা রাসেদ প্রধান আরও জানান, দুই একর জমিতে প্রথম বছর জমি তৈরি, সার, চারা, লেবার খরচসহ অন্যান্য খরচ বাবদ তার ১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন প্রতিবছর সারসহ পরিচর্যা বাবদ খরচ হচ্ছে দেড় লাখ টাকা। কিন্তু কেউ যদি অল্প জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করেন তাদের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ একটু বেশি পড়বে। এরপরও এটি একটি বাণিজ্য সফল ফল। এই উদ্যোক্তার দাবি, কৃষকদের উৎসাহিত করতেই পঞ্চগড়ের এই ড্রাগন ফল বাগান এবং নার্সারি প্রকল্প স্থাপন করেছেন। ইতোমধ্যে নার্সারি থেকে ৩ লাখ টাকার চারাও তিনি বিক্রি করেছেন। তার দেখাদেখি জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট আকারের কয়েকটি ড্রাগন ফল বাগান গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে বাড়ির আঙিনায় এবং ছাদের টবে ড্রাগন ফল চাষ করছেন। ড্রাগন ফল মূলত আমেরিকার প্রসিদ্ধ একটি ফল। থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে এই ফলের বিভিন্ন জাত এনে ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে এর চাষাবাদ শুরু হয়। ড্রাগন ফলের গাছ এক ধরনের ক্যাকটাস জাতীয় গাছ। এই গাছের কোন পাতা নেই। ড্রাগন ফলের গাছ সাধারণত ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এ ফলের আকার বড়, কাঁচা অবস্থায় খোসার রং সবুজ এবং পাকলে টকটকে লাল হয়ে যায়। শাঁস গাঢ় গোলাপী রঙের, লাল ও সাদা এবং রসালো প্রকৃতির। ফলের বীজগুলো ছোট ছোট কালো ও নরম। একটি ফলের ওজন ১৫০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ড্রাগন ফলে আছে জীবনরক্ষাকারী নানা পুষ্টিগুণ। এতে আছে ভিটামিন সি, মিনারেল এবং উচ্চ ফাইবারযুক্ত। ড্রাগন ফলে ফিবার, ফ্যাট, ক্যারেটিন, প্রচুর ফসফরাস, এসকরবিক এসিড, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন রয়েছে। বোদা উপজেলা কৃষি অফিসার আল মামুন অর রশিদ জানান, সুনিষ্কাশিত উঁচু ও মাঝারি জমি ড্রাগন ফল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। ২-৩টি চাষ দিয়ে ভালভাবে মই দিয়ে জমিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করতে হবে। যাতে করে পানি আটকে না থাকে। ড্রাগন ফল রোপণের জন্য উপযোগী সময় হলো মধ্য এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তিনি বলেন, চারা রোপণের আগে তিন মিটার পর পর গর্ত করে ২০-২৫ দিন পর প্রতি গর্তে ২৫-৩০ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ১৫০ গ্রাম জিপসাম এবং ৫০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট সার গর্তের মাটির সঙ্গে ভাল করে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। এরপর ১০ থেকে ১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৪টি করে চারা সোজাভাবে মাঝখানে লাগাতে হবে। ৪টি চারার মাঝে একটি সিমেন্টের ৪ মিটার লম্বা খুঁটি পুততে হবে। চারা বড় হলে খড়ের বা নারিকেলের রশি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে যাতে কান্ডা বেল হলে খুঁটিকে আঁকড়ে ধরে গাছ সহজেই বাড়তে পারে। প্রতিটি খুঁটির মাথায় একটি করে সাইকেল বা মোটরসাইকেলের ডায়ার মোটা তারের সাহায্যে আটকিয়ে দিতে হবে। সহজেই যেন গাছের মাথা ও অন্যান্য ডগা টায়ারের ভেতর দিয়ে নিচে ঝুলে পড়ে। কারণ ঝুলন্ত ডগাতে ফল বেশি ধরে। এপ্রিল-মে মাসে ফুল আসার পর ২০-২৫ দিনে মধ্যে ফল হয়। অক্টোবর-নবেম্বর পর্যন্ত ফুল ও ফল ধরা অব্যাহত থাকে। একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ২০ থেকে ১শ’টি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায় এবং ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায় বলে তিনি জানান।
×