ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কলেরা বসন্ত থেকে মুক্তি পেতে আঁকা হতো পট

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১২ জুলাই ২০২০

কলেরা বসন্ত থেকে মুক্তি পেতে আঁকা হতো পট

মোরসালিন মিজান ॥ পটচিত্র অঙ্কন ও তার সঙ্গে মিল রেখে গান তৈরি ও গাওয়ার দিন ফুরিয়েছে। এই চর্চা এখন আর সেভাবে দেখা যায় না। তবে প্রাচীন বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকঐতিহ্যের আলোচনায় শক্ত অবস্থান পটের। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, বিচিত্র বিষয় নিয়ে পট আঁকা, গান তৈরি ও গাওয়া হতো। একইভাবে পটের বিষয় হয়ে এসেছে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। রোগ-ব্যাধি। যুগে যুগে, কালে কালে আসা মহামারী থেকে উদ্ধার পেতে এই ধারার ছবি এঁকে গান বেঁধে মহান প্রভুর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আজ যখন কোভিড-১৯’র আঘাতে গোটা দুনিয়া পর্যুদস্ত, প্রতি মুহূর্তে সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যু হচ্ছে মানুষের তখন লোকজ সেই চর্চার কথা মনে পড়ে যায়। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তবে একদিন হবে। কেটে যাবে এই মহাদুর্যোগ। এমন আশা অবলীলায় আমরা করতে পারি। কিন্তু এক সময় মহামারী থেকে বাঁচার স্বীকৃত কোন পথ জানা ছিল না মানুষের। রোগ-ব্যাধির কাছে সবাই ছিল অসহায়। সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতেন তারা। একই প্রার্থনা হতো পটের ভাষায়। পটচিত্র মানে, পটে আঁকা চিত্র। পট শব্দের অর্থ কাপড়। কাপড়ের ওপর দেশী রং দিয়ে এ ছবি আঁকা হতো। বারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত চর্চাটি বিশেষ পরিলক্ষিত হয়। যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না তখন পটচিত্র প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করেছিল। যারা পট আঁকেন তারা পটুয়া নামে পরিচিত। স্বশিক্ষিত শিল্পীরা বংশানুক্রমিকভাবে পটচিত্র আঁকার কাজ করতেন। চিত্র দেখিয়ে গান করতেন। গানে গানে কেচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করতেন তারা। পটের বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র। বিষয়ভেদে পটকে ছয় ভাগে ভাগ করা হতো। সেগুলোর মধ্যে ছিল ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, পরিবেশগত ও বিষয়নিরপেক্ষ পট। ধর্মীয় নানা বিষয় ও পৌরাণিক কল্পকাহিনী বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রামকাহিনী, কৃষ্ণকাহিনীসহ বহুবিধ পৌরাণিক কাহিনী বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। মুসলমানদের গাজীর পটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী, গাজী পীরের বীরত্বগাঁথা অলৌকিক কর্মকা- তুলে ধরা হয়েছে। ধর্মীয় বিধি-বিশ্বাসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণীর ছবি, ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদি আঁকা হতো। তুলে ধরা হতো ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামত। সমকালীন ঘটনাবলী নানা ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হতো। একইভাবে রোগ-ব্যাধি পটের বিষয় হয়ে এসেছে। লোক গবেষক সায়মন জাকারিয়া জানান, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মহামারী কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। পটের গানে এসব রোগ ব্যাধির উল্লেখ পাওয়া গেছে। এক সময় বসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের মতো রোগে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। এসব রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে পটে দেবদেবীর ছবি এঁকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখানো হতো। পুজো করা হতো। বিশ্বাস করা হতো, পুজো করে দেব-দেবীকে খুশি করা গেলে রোগমুক্তি মিলবে। এ প্রসঙ্গে জানতে কথা হয় নড়াইলের পটুয়া নিখিল দাসের সঙ্গে। প্রথা মেনে ডেঙ্গু নিয়ে পট এঁকেছেন তিনি। এঁকেছেন করোনা নিয়েও। কিন্তু ৮ থেকে ১০ জনের দল নিয়ে গাইতে হয়। সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। তাই কিছুটা হতাশ। তবে পেছনে ফিরে গিয়ে জনকণ্ঠকে পটুয়া বলেন, বিনোদন দেয়ার পাশাপাশি পটশিল্পীরা সমাজের অনেক দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করতেন। বড় আকারে রোগব্যাধি দেখা দিলে বিশেষ তৎপর হয়ে উঠতেন তারা। আলাদা একটি দলই ছিল যারা মহামারী থেকে বাঁচার আকুতি সংবলিত পট আঁকতেন ও গান গাইতেন। দেব-দেবীর ছবি এঁকে তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখাতেন। বিশেষ করে দেবী শীতলার কথা উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, বসন্ত দেখা দিলে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে একটি বাক্সের ওপর বসিয়ে সে বাক্স গলায় ঝোলানো হতো। পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেবীর পট দেখাতেন তারা। চাল ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন। পরে ছবির সামনে পুজোর আয়োজন করে রোগমুক্তির প্রার্থনা করা হতো। পটুয়াদের একটি দল ঝাড়ফুঁক দেয়ার কাজও করতেন বলে জানান তিনি। আরেক খ্যাতিমান পটুয়া শম্ভু আচার্য্য জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সমাজে অনাচার দেখা গেলে নগরকীর্তনের আয়োজন করা হতো। কোন রোগবালাই দেখা দিলেও এগিয়ে আসতেন পটুয়ারা। আজ থেকে ৬০ বছর আগে আমি দেখেছি কার্তিক বা বৈশাখের গরমে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। তখন পটুয়ারা দেব-দেবীর ছবি এঁকে ধূপ জ্বালিয়ে সকালে ও সন্ধ্যায় গান করতেন। গরুর মড়ক দেখা দিলেও এ ধরনের আয়োজন করা হতো। একদিকে কীর্তন অন্যদিকে জিকির হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক রূপটাই পটকে সবার করেছিল। আজকের করোনারকালেও পটুয়ারা ঐতিহ্য মেনে ছবি আঁকছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী ১৬ জুলাই শিল্পকলা একাডেমিতে এ ধারার ছবি আঁকব আমি। আঁকলে মহামারী থাকবে না, এমন নয়। তবে আমরা শিল্পীরা আমাদের আশার কথা তো প্রকাশ করতে পারি। সেটিই করব। একই সঙ্গে লোকঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার দাবি জানাব আরও একবার।
×