ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

এ সময়ে ভেজাল খাদ্য

প্রকাশিত: ২১:২০, ১২ জুলাই ২০২০

এ সময়ে ভেজাল খাদ্য

মানুষের জীবন ধারণ ও জীবন যাপনের জন্য যতগুলো চাহিদা রয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য হচ্ছে প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। কিন্তু এ দেশের জনগণ প্রতিদিন যেসব খাবার খান, তা কি সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ বা ভেজালমুক্ত? নিশ্চয় না। তার মানে, জনগণ প্রতিনিয়তই ভেজাল খাবার খাচ্ছেন। ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে জনগণ মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছেন না। তবে একদিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যক্তিদের ফলে মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভেজালমুক্ত খাদ্য যেমন দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ প্রতিরোধ করে, তেমনি ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন বিপন্ন পর্যন্ত হতে পারে। তাই ‘সকল সুখের মূল’ নামক স্বাস্থ্যকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, গুড়, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যই ভেজালে পরিপূর্ণ। এমনকি এ দেশে শিশুখাদ্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হয়েছে এবং ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ছাড়ও পেয়েছেন, যা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয়। বলাবাহুল্য, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে কাউকে ন্যূনতম ছাড় পর্যন্ত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে বাস্তবে ঘটছে উল্টো ঘটনা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই কঠিন সময়েও এ দেশে থেমে নেই খাদ্যে ভেজাল দেয়ার প্রবণতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ১০ মে রাজধানীর বাদামতলীতে র‌্যাব ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অভিযান চালায়। র‌্যাবের ভাষ্য মতে, আরও সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সেখানে রঙিন কাঁচা আম আড়তগুলোতে বিক্রি হচ্ছিল। অথচ তখন পর্যন্ত আম পাকার বা আম গাছ থেকে নামানোর সময় হয়নি। করোনার হাত থেকে যখন মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে; কোয়ারেন্টাইন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিংসহ নানা রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে; সরকার যখন মানুষকে নানা বিষয়ে সতর্ক করছে; বিজ্ঞানীরাও যখন মানুষকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, ঠিক তখনই এ দেশে চলছে বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল মেশানোর চির পরিচিত খেলা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরে ইমিউনিটি ভাল থাকলে ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চললে করোনা সহজে কাউকে সংক্রমিত করতে পারবে না। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যখন করোনার কোন টিকা বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তখন যার যার শরীরের ইমিউনিটিকে রক্ষা করার জন্য সবাই কত চেষ্টাই না করছে। কারণ, এটাই এখন আত্মরক্ষার জন্য অন্যতম প্রধান বর্ম। সুতরাং, একে কিছুতেই নষ্ট করা যাবে না, বরং শরীরে এই ইমিউনিটি কিভাবে বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। আমাদের দেশে এখন চলছে আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের মৌসুম। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব বা পাকানো ফল ও শাকসবজির মধ্যে ইমিউনিটি বাড়ানোর অসীম ক্ষমতা থাকে। তাই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে অবশ্যই আমাদের প্রত্যেকের শরীরে ইমিউনিটি বাড়ানো অত্যন্ত জরুরী বিষয়। কিন্তু ফরমালিন মেশানো আমসহ বিভিন্ন ফল, শাক-সবজি এবং ভেজাল মেশানো বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্য খেয়ে সেই ইমিউনিটি বাড়ানোর বদলে নিজের অজান্তেই কমে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং তা আমাদের সকলের জন্যই এক অশনিসংকেত বটে। অনেক সময় দেখা যায়, ফল পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফল পাকানোয় ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষè ছিদ্র দিয়ে ফলের ভেতরে প্রবেশ করে। আর এ ধরনের ফল খাবার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশ বিশেষ শরীরে ঢুকে পড়ে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে থাকে। বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মারা যাচ্ছেন। খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল (যেমন ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার বা পিপিটি, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও নিন্দিত হয়ে আসলেও জনগণ যেন এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিল্প খাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু প্রতি বছর ফরমালিন আমদানি করা হয় প্রায় ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে। অনেক সময় বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিন মুক্ত ঘোষণা করতে দেখা যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আগে যা ছিল কয়েকদিন পরে আবার তা-ই হয়েছে। ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে দেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন, বিশেষ করে এই করোনার সময়ে। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে অগণিত শিশু, যাদেরকে বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যত। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সকলের জন্যই উদ্বেগজনক। আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুত গতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই, এসব বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দ্রুত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড এ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির দীর্ঘদিনেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারাদেশে স্বতন্ত্রভাবে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। অবস্থা এমন যে, খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। প্রতি বছর ১৫ মার্চ এলে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়। সারাদেশ যখন ভেজালযুক্ত খাদ্যে ভরে গেছে, তখন এমনি পরিস্থিতিতে কনজ্যুমার রাইটস সোসাইটি ও কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়। জনগণের সচেতনার অভাবসহ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে কোনভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ভেজাল খাদ্যের ফলে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশু বিকলাঙ্গ হওয়া এবং শিশুখাদ্যে ভেজাল মেশানো আগামী প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে এক অশনিসংকেতই বটে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে অধিক মুনাফার লোভে খাদ্য-দ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা সমাজের শত্রু, জনগণের শত্রু এবং এরা করোনার চেয়ে কোন অংশেই কম ক্ষতিকর নয়। অনেক সময় এদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হলেও তারা ঘুষ, পেশী শক্তিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। নিরাপদ খাদ্য আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা এবং জনগণ সচেতন ও সোচ্চার না হওয়ায় খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। অতি দ্রুত যদি এ অবস্থার যদি ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন ঘটানো না হয়, তাহলে আগামীতে এর কুফল যে কী ভয়ানক ও বিপজ্জনক হবে, তা সময়মতোই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। তাই খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো রোধে খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সচেতন সকলের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আশা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজালরোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নৈতিকতাবোধকে জাগ্রত করা, নিজের বিবেককে জাগ্রত করা। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
×