ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘উগ্র-ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করা না হলে ভবিষ্যতে মহাসঙ্কটের সম্মুখিন হবে দেশ’

প্রকাশিত: ১৯:৫৫, ১১ জুলাই ২০২০

‘উগ্র-ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করা না হলে ভবিষ্যতে মহাসঙ্কটের সম্মুখিন হবে দেশ’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কবর থেকে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের শিশুর লাশ তুলে ফেলার পৈশাচিক ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি মানবাধিকার নেতা বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভাপতি লেখক, চলচ্চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার কবির। আজ শনিবার সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানানো হয়। এদিকে আহমদীয়া মুসলিম জামাত বলছে, ঘাটুরায় ঘটনা উগ্র-ধর্মান্ধদের বিকৃত মানসিকতার বহিপ্রকাশ। এক যৌথ বিবৃতিতে নির্মূল কমিটির শীর্ষ নেতৃদ্বয় বলেন, ‘আজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দাফনের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের এক শিশুর মরদেহ কবর থেকে তুলে ফেলার সংবাদ আমাদের অত্যন্ত ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে। আমরা এই পৈশাচিক অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার দাবি করছি। বিবিৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা দীর্ঘকাল ধরে লক্ষ্য করছি ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের উগ্র মৌলবাদী সহযোগীরা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদির হত্যা ও সন্ত্রাসের দর্শন বাস্তবায়নের জন্য আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর বার বার হামলা চালাচ্ছে। তাদের হত্যা করছে। ঘরবাড়ি ও মসজিদ ধ্বংস করছে। অথচ এসব নৃশংস অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং দেশের ভেতর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সহ নাগরিকদের বিভিন্ন ফোরাম থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ ও নিন্দাজ্ঞাপনের পরও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। যার ফলে মওদুদিবাদী, ধর্মব্যবসায়ী, মৌলবাদী দুর্বৃত্তরা করোনাকালের এই ঘোর দুর্দিনে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের একজন হওয়ার কারণে কবর থেকে শিশুর লাশ তুলে ফেলার মতো ভয়ঙ্কর পৈশাচিক কান্ড করতে উৎসাহী হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এই ঘৃণ্য অপরাধীদের গ্রেফতারের পরিবর্তে যেভাবে তথাকথিত সালিশের নামে অপরাধের ঘটনা চাপা দিয়ে অপরাধীদের শাস্তিপ্রদান এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে তা মানবাধিকারের গুরুতর লংঘন এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী। এর আগে গোপালগঞ্জে নিখিল তালুকদার হত্যাকান্ডের ঘটনা এভাবে সালিশের নামে ধামাচাপা দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা একই ধরনের অপরাধ করেছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর সংঘটিত এ ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধ সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তিকে ক্রমাগত প্রশ্রয় দেয়া হলে প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অপরাধকেই প্রশ্রয় দেয়া হবে, যা অপরাধীদের অধিকতর অপরাধে প্ররোচিত করবে এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করবে। ‘আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায় এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সংবিধানপ্রদত্ত সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতা ও অবহেলার বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। একই সঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে এ ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসী নাগরিকদের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার ও মর্যাদা থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত করা হলে অন্তিমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি যে কলঙ্কিত হয়, এ বিষয়টি সরকার ও প্রশাসনকে সব সময় মনে রাখতে হবে।’ ঘাটুরায় ঘটনা উগ্র-ধর্মান্ধদের বিকৃত মানসিকতার বহিপ্রকাশ ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের ঘাটুরা গ্রামের অধিবাসী জনাব আব্দুর রাজ্জাকের কন্যা মোছাম্মত স্বপ্না আক্তারের নবজাতক শিশুর তিন দিনের দিন মৃত্যু ঘটলে তাকে ঘাটুরা সরকারি কবরস্তানে দাফন করা হয়। কিন্তু দাফনের কিছুক্ষণ পর উগ্র-ধর্মান্ধরা তিন দিনের এই নবজাতক নিষ্পাপ শিশুকে কবর থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে রাখে। এই শিশুর ‘অপরাধ’ সে ঘাটুরা নিবাসী এক আহমদীয়া মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল। যদিও পরে প্রশাসনের নির্দেশে মৃত নবজাতকের পরিবারের সদস্যরা উপড়ে ফেলা সেই লাশ নিয়ে দশ কিলোমিটার দূরে অন্য আরেক কবরস্তানে দাফন করে। ঘাটুরায় ঘটে যাওয়া এই পৈশাচিক ঘটনা উগ্র-ধর্মান্ধদের বিকৃত মানসিকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কেননা, মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ফিরকা এবং দল-উপদল যেভাবে বাংলাদেশে মুসলমান হিসাবে স্বীকৃত তেমনিভাবে আমরা, অর্থাৎ আহমদীয়া মুসলিম জামাতের সদস্যরাও মুসলমান হিসাবে পরিগণ্য। আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) বলেছেন, আমরা ঈমান রাখি, খোদা তা’লা ছাড়া কোন মাবুদ নাই। সংগঠনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সাথে অন্যান্য সাধারণ মুসলমানদের তফাৎ বা মতবিরোধ কেবল একটি ভবিষ্যদ্বাণীকে কেন্দ্র করে। আহমদীরা বিশ্বাস করে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী যথাসময়ে এসে গেছেন আর অন্যরা বিশ্বাস করে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) এখনও আসেন নি, কিন্তু আসবেন। এখন পর্যন্ত আহমদীরা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলমান হিসাবেই পরিগণ্য এবং আমরা নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবেই বিশ^াস করি। অতএব এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মুসলমানদের গোরস্তানে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের আহমদী মুসলমানের কবর হবে না একথা সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের জন্য অবিশ^াস্য! ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও গতকালের (৯ জুলাই) বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। কেননা, আস্তিক-নাস্তিক, মুসলমান-অমুসলমান সবার শেষ ঠাঁই খোদার সৃষ্ট এ মাটিতেই হয়। সমস্ত ধর্মীয় মতবিরোধ সত্ত্বেও আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামীন’ জগতসমূহের একমাত্র প্রতিপালক হিসাবে সবাইকে সমভাবে লালনপালন করে থাকেন। বিশ্বাসের বিরোধ থাকা সত্ত্বেও সবাইকে একই মেঘের পানি দিয়ে তিনি সিঞ্চিত করেন। আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে তাঁর সৃষ্ট সূর্য নিজের রোদ সমভাবে প্রদান করে। আমরা ঘাটুরাস্থ আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সদস্যবৃন্দ আমাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার হরণ করার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এ ঘৃণ্য অপরাধের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। একইসাথে, যদি উগ্র-ধর্মান্ধদের চাপে আমাদেরকে সরকারি সাধারণ গোরস্তানে দাফন হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয় সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভিন্ন সরকারি গোরস্তান বরাদ্দ করার দাবি জানাচ্ছি। উগ্র-ধর্মান্ধদের এখনই প্রতিরোধ করা না হলে আমাদের দেশ ও সমাজ অদূর ভবিষ্যতে মহাসঙ্কটের সম্মুখিন হবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।
×