ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কালের কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০০:৪৮, ১০ জুলাই ২০২০

কালের কণ্ঠস্বর

‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান আমার মায়ের মুখ; নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাইবোন আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনিÑরাবেয়া রাবেয়া আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট।’ (কবিতা এমন) কবিতাকে নিয়ে এমন সহজতর উচ্চারণ, এমন নিখাদ বর্ণনাশৈলী তাকেই মানায়, যিনি কবিতাকে শুধু যন্ত্রস্থই করেনি, করেছেন আত্মস্থও। আল মাহমুদ, বাংলা কবিতায় এক অনিবার্য নাম। প্রবল জীবনযুদ্ধ যাকে থামাতে পারেনি এতটুকু, বিরুদ্ধস্রোত যাকে ভাসিয়ে নিতে পারেনি সামান্যতমও। ছোটখাটো অথচ ঋজু ও ঋদ্ধ এ মানুষটি আজীবন কবিতার কথা বলে গেছেন, আপনভূমি কর্ষণে কর্ষণে রোপণ করে গেছেন অগণিত কবিতার বীজ। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিকতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আঞ্চলিক শব্দাবলীর যথাযথ ও নিপুণ প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মনে তিনি পুলক সঞ্চারণ করেছেন অবলীলায়। তিরিশের সুতীব্র কাব্য প্রবণতার মধ্যেই গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জলজীবন, চরাঞ্চলের জীবনযাত্রা, ভাটি বাংলার কথকতা আর নরনারীর প্রেম বিরহের চিরায়ত সুনিপুন ধ্বনি নিয়ে কাব্যরচনা করে নিজেই পরিণত হয়েছেন একটি মিথ-এ। স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর ঢিলেঢালা পাজামা পরা ছেলেটি যে একদিন বাংলা কবিতাকে কাঁপিয়ে দেবে তা হয়তো তার যৌবনে ভেবে উঠতে পারেনি কেউ। বাবার সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, ম্লান মায়ের মুখ, বাঁশঝাড়ে ঢাকা দাদার কবর, কুয়াশায় আঁকা পথ, পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ আর চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম এবং গন্ধভরা ঘাসের স্মৃতি কবিতা হয়ে যার শ্লেটে আলো ফেলে তাকে তো ধারণ করে নেবে তার সমকাল, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কালকে অতিক্রম করে তিনি যখন পা রাখেন মহাকালের বুকে তখন বিস্মিত হতে হয় বৈকি। আল মাহমুদ সেই কাজটাই করে গেছেন আর করে গেছেন বলেই মৃত্যুর পরও তিনি আলোচনায়। তার জন্য ভালবাসার ডালি সাজিয়ে বসে আছে তার পরবর্তী প্রজন্ম। নাহ্ তিনি স্যুররিয়ালিজম নিয়ে টানাটানি করেননি, আধুনিক বিশ্বকবিতা নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি তার কাছে ছিল না অতটা গ্রাহ্য। তিনি লিখে গেছেন আপন খেয়ালে, আত্মার টানে। মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার কিংবা ম্লানমুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর তাই তার কবিতায় উঠে এসেছে অত্যন্ত স্বাভাবিকতায়। আর তা কবিতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে তার কালে এবং পরবর্তী সময়েও। একজন কবির এই যে কাব্যশক্তি, তা কালের কাছে শুধু চমৎকৃত নয়, ঈর্ষণীয়ও। ‘নদীকে ডেকেছিলাম বলে, নদী তার গতিপথ ছেড়ে ঢেউ তোলে আমার আবাসে। আমি প্রান্তরে হারিয়ে পথ, ‘তাহেরা তাহেরা’ বলে এক গেঁয়ো যুবতীর নামে একবার ডাকতেই আপন সংসার ভেঙ্গে এসেছিল অসংখ্য যুবতী।’ (একবার তাকাতেই) বিশ্বাস ও আস্থার এই যে ধ্বনি, এত এক পরিপূর্ণ কবিতার ধ্বনি। আর এই দৃঢ়তর উচ্চারণ যার পক্ষে সম্ভব তিনি আল মাহমুদ। নদীরা ছুটে আসলো কিনা সেটা বড় কথা নয়, নদীরা ভিড় জমালো কিনা সেটাও ধর্তব্য নয়- একজন কবি যে এমনতরো হৃদয়ঘন ডাক পাঠাতে পারেন সেটাই উল্লেখ্য। আল মাহমুদ পেরেছেন এবং তার বিশ্বাসে গেঁথে নিয়েছেন এর প্রতিউত্তরও- এটাই কবির অর্জন, কবির অহঙ্কার। সা¤্রাজ্য ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর আল মাহমুদ চিরকাল মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে কথা বলেছেন বলেই লিখতে পেরেছেন- ‘সিদ্ধহস্ত খুনীদের নব্যতর বিশ্বের বিধানে একঠ্যাঙে বসে আছে জাতিসংঘ বিবেকের বক।’ প্রত্যাবর্তনের লজ্জায় ¤্রয়িমান আল মাহমুদকে যখন কালো চোখের কাসিদা নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখি তখন আশ্চর্য হতে হয় বৈকি। খড়ের গম্বুজে দাঁড়িয়ে পালা ভাঙ্গার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে যখন তিনি লেখেন, ‘এ মুখ আমার নয়, এ মুখ আমার নয়, বলে যতবার কেঁপে উঠি, দেখি আমার স্বজন হয়ে আমার স্বদেশ এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। নির্ভয়ে আশ্বাসে জিয়ল মাছের ভরা বিশাল ভা-ের মতো নড়ে ওঠে বুক।’ তখন তার অবারিত দেশপ্রেমে আমরা মুগ্ধ হয়েছি, আনত হয়েছি। অঙ্কের সমীকরণ কি সত্যিই মেলে? কে জানে। অর্থহীন লাল হরতনে সাজানো মায়াবৃক্ষ তিতাসের ঘোলা জলের প্রহারে ভেসে গেলে একদিন কবি তো উৎকণ্ঠিত হতেই পারেন। অরণ্যে অসুখী হয়ে বৃষ্টির অভাবে ক্যামোফ্লাজ আঁকতে পারেন নিজেরই চোখের তলদেশে। আল মাহমুদ ছিলেন প্রকৃতিবাদী এবং ঈশ্বরবাদীও বটে। তবুও তার রুপার রেকাবিতে জমা হয়েছিল রাজভিখারির দাবি। তিনি শোকের লোবানে ঢেকে নিজের ব্যর্থতা, কম্পিতা কোন কুমারীর নি¤œ নাভীমূলে লিখে দিতে চেয়েছিলেন গোপনের তীব্র কবিতা। কবিতার ক্যানভাস যতই বিস্তৃত হোক আল মাহমুদ কখনই আহরিত শব্দাবলী কিংবা অন্যের চেতনা ধার করে কবিতা লেখেননি। তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যের মৌলিকতা এবং বহমানতা। এ কারণেই কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিবনারায়ণ রায় তার সম্পর্কে লিখেছেন, পঁচাত্তর সালে আল মাহমুদের সঙ্গে প্রথম চাক্ষুস পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই আমি তাঁর কবিতায় মুগ্ধপাঠক। সমকালীন যে দু’জন বাঙালী কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বার বার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ শিবনারায়ণ রায়ের মতো প্রাজ্ঞজন যার কবিতার মৌলিকতায় বিস্মিত ও চমকিত, নতুন করে তাকে আর ব্যবচ্ছেদ করার প্রয়োজন আছে কি? কবিতা এবং একমাত্র কবিতাতেই নিবিষ্ট আল মাহমুদ চিরকাল দ্বারস্থ হয়েছেন তার কবিতারই কাছে। কবিতা ছাড়া তার কোন ভাবনা ছিল না, কবিতা ছাড়া অন্য কোন প্রার্থনা তাকে কোন কালেই আকৃষ্ট করেনি। হয়ত তাই তিনি প্রণয়ীর কাছেও উপস্থিত হন তারই কবিতার মতো এক সরল সহজ উচ্চারণেÑ ‘ভালোবাসা দাও যদি আমি দিব আমার চুম্বন ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।’ (সোনালী কাবিন) আল মাহমুদের জীবনযৌবন প্রেম প্রণয় এবং হৃদয়ের লেনাদেনা, চুম্বন-শীৎকার সবকিছু ঘিরেই ছিল বিশুদ্ধতা। সবকিছু আবর্তিত ছলনাহীনতায়, ঈশ্বর এবং কবিতায়। ধাতুর ওলান থেকে পবিত্র অক্ষর কেড়ে নিয়ে সক্রেটিসের মোরগের পাখায় এঁকে যিনি সহসা কৃষ্ণের জীব হয়ে উঠতে পারেন একমাত্র তিনিই বলতে পারেনÑ ‘একমাত্র জ্ঞান ছাড়া সবি কালের অধীন যেমন পুকুরে ভাসে নিরিবিলি পদ্মের কোরক ভেসে থাকে নিস্তরঙ্গ পাতার আশ্রয়ে। শুধু চাই সূর্যালোক শুধু চাই- স্বাধীন বাতাস। মৃণালের ভর চাই আর চাইদ মাটির আদর। মাটিই পরম স্পর্শ, মাটি শেষ সমতার মতো। মাটির গন্তব্যে বিশ্বাসীজনের কাছে মাটিই হবে পরম আরাধ্য আর সেই পরম আরাধ্যের স্পর্শ তার অন্তরে স্থিত হবে সমতার উচ্চারণে। আল মাহমুদ তেমনই একজন, যিনি সেই স্পর্শের জন্য উদগ্রীব এবং সেই স্পর্শ নিয়েই হারিয়ে যেতে চান কাল থেকে কালান্তরে। আধুনিক বাংলা কবিতার বিস্ময় পুরুষ আল মাহমুদ জীবনকে যেভাবে উপভোগ করেন তেমনি তার আরাধ্য হিসেবে বেছে নেন মৃত্যুকেও। তার কাছে মৃত্যু যেন প্রণয়ীর একান্ত আদর- ‘কালের দৃষ্টান্তে ভরা পৃথিবীতে কি আছে নতুন তোমার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট ঘষে মনে হলো কাল নারীর নুনের মধ্যে আছে এক মায়াবী আগুন যার লোভে মহাকাল জন্ম দেয় প্রতিটি সকাল। মরণই বিজয়ী বটে মানি সবি মৃত্যুর অধীন তবুও কণ্ঠার নিচে জমে থাকা রক্তাভ মশায় প্রভাতী ¯œাণের বিন্দু একফোঁটা দেখে একদিন ভাবি কার সাধ্য এই মানবিক বিভাকে খসায়?’ (কালের অভয়) নারী এবং মৃত্যুকে এক একান্ত দোলায় একাত্ম করতে পারা আল মাহমুদের পক্ষেই সম্ভব এই উচ্চারণ। স্মৃতি ভারাতুর কবি ছিন্নভিন্ন স্মৃতিসূত্রে গেঁথে গেছেন তার অতীত। তার কাছে পরিপূর্ণ জীবনটাই যেন একটা স্মৃতিরহীরক। যার দ্যুতিতে তিনি ঝলসে ওঠেন, আলোময় হয়ে ওঠে তার নিজস্ব ভুবন। ‘জীবন কি স্মৃতিমাত্র? নইলে কেন শত তরঙ্গভঙ্গে আছড়ে পড়ে স্মৃতি?’ এই আল মাহমুদই একটু পরে তার কবিস্বভাবে ভুলে যান সবকিছু এবং নিজেকে সমর্পণ করেন সময়ের হাতে আর বলে ওঠেন- ‘অথচ ভুলে যাই আজ সকালের সবমুখ, সব বিনিময়’- (ছিন্ন ভিন্ন স্মৃতিসূত্র) এই তো কবির স্বভাব। কবির উচ্চারণ। যা আলোময় ছায়াময় দ্বন্দ্বে বিচূর্ণ হয় আর উদ্ভাসিত করে তার সত্তাকে। আল মাহমুদ, সাম্যের কবি মানবতার কবি। প্রেমের কবি, দেহের কবি। তার চরিত্রে ক্রমশ শিকড় গাড়েন রমণীরা, তাদের দেহজ উদ্দামতায় উচ্ছল কবি ছুটে চলেন শব্দযানে ঈশান থেকে বায়ুতে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং সুমেরু কুমেরু অথবা এন্টার্টিকায়। ভালবাসার ¯্রােতগাঁথায় ভাস্বর এই প্রেমিক কবিই আবার শ্রদ্ধায় আনত হন মহান ¯্রষ্টা, মহান প্রভুর কাছে। তার কাছে তখন সবচেয়ে গভীর হয়ে ধরা দেয় বিধাতাপ্রেম। মহান প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি অচঞ্চল বর্ণনা করতে থাকেন তাঁর মহত্বগাঁথা এবং জন্মদানের কৃতজ্ঞতায় তাঁর প্রতি আনত হয়ে প্রদান করতে থাকেন ভক্তি ও ভাবের নৈবেদ্য। আল মাহমুদ বেঁচে থাকুন তার কবিতায়, অগণিত মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় একটি অতিচঞ্চল অথচ প্রার্থিত নক্ষত্র হয়ে।
×