ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জেএসএস ও ইউপিডিএফ দাবি আদায়ের পথ থেকে সরে গেছে বহুদূর

আধিপত্য ও চাঁদাবাজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রক্ত ঝরছে পাহাড়ে

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ১০ জুলাই ২০২০

আধিপত্য ও চাঁদাবাজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রক্ত ঝরছে পাহাড়ে

মোয়াজ্জেমুল হক/ জীতেন বড়ুয়া ॥ ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং চুক্তি না মেনে তা বাতিল দাবিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) যে এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছিল তা থেকে এখন বহুদূর পেছনে। জেএসএস এবং ইউপিডিএফ দুটি সংগঠনই দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইসহ একক চাঁদাবাজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় এরা নিজেরা নিজেদের রক্ত ঝরাচ্ছে। সবুজ পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে গেল ২২ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ছয় শ’র বেশি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। হত্যাকা-ের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটল বান্দরবানে গত মঙ্গলবার। এ ঘটনায় জেএসএস সন্তু গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়া জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের ছয় নেতা প্রাণ হারাল। পাহাড়ে বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির গহিন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে এ দুটি সংগঠন ও এর উপগ্রুপগুলোর কিলিং মিশন সক্রিয় থেকে টার্গেটকৃতদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এ জাতীয় ঘটনা বিস্তৃত হয়েছে এখন বান্দরবানেও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুই সংগঠনের প্রতিপক্ষরা বর্তমানে সশস্ত্র অবস্থানে রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বড় দুই আঞ্চলিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফের উপশাখাগুলোর মধ্যে মাঝখানে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কথা চাউর হয়। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান যে, নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব আঞ্চলিক সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯৮ সালে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে ৩১২ নেতাকর্মী। পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর জেএসএস সন্তু লারমা গ্রুপের নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে দুই শতাধিক। এছাড়া বান্দরবানের বাগমারায় গত ৭ জুলাই জেএসএস লারমা গ্রুপের ৬ নেতাকর্মীসহ এ পর্যন্ত এ গ্রুপের প্রাণ গেছে ৮৫ জনের। এছাড়া ২০১৭ সালে আত্মপ্রকাশের পর থেকে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রাণ গেছে ১০ নেতাকর্মীর। প্রসঙ্গত, খাগড়াছড়িতে জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের আধিপত্য রয়েছে। এ গ্রুপের দ্বিতীয় অবস্থান রাঙ্গামাটি। বান্দরবানে এ গ্রুপের জেলা সমন্বয়ক রতন তঞ্চঙ্গ্যার নেতৃত্বে তাদের কার্যকলাপ বিস্তৃত করার তৎপরতাকে জেএসএস সন্তু গ্রুপ মোটেই ভালভাবে নেয়নি। ফলে লারমা গ্রুপকে টার্গেট করে ৭ জুলাই হত্যাকা- ঘটানো হয়। এ ঘটনায় জেলা সমন্বয়ক রতন তঞ্চঙ্গ্যা, খাগড়াছড়ি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য চিং থোয়াই অং মার্মা ডেভিট, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির খাগড়াছড়ি শাখার সদস্য গোবিন্দ চাকমা মিলন, রিপন ত্রিপুরা, জ্ঞান ত্রিপুরা প্রাণ হারান। এ ঘটনার পর নতুন করে আরও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা, এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ছাড় দিতে নারাজ। কয়েক বছর আগেও বান্দরবানে পাহাড়ী আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী তৎপরতা তেমন ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক জেএসএস সন্তু লারমা, জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপ (সংস্কারপন্থী), ইউপিডিএফ এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘মগ পার্টি’ নামে আরও একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতা। পাহাড়ে অশান্ত পরিবেশের জন্য সন্তু লারমাকে দায়ী করে জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা জানান, সন্তু লারমার অদূরদর্শিতার কারণে পাহাড়ে স্থায়ী সমাধান আসছে না। চুক্তি বাস্তবায়নের পথে তৎপর না থেকে সন্তু লারমা চুক্তির বিরোধী পক্ষ ইউপিডিএফের কিছু নেতার সঙ্গে আঁতাত করে পাহাড়ে একের পর এক হত্যাকা- ঘটিয়ে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। অপরদিকে, ইউপিডিএফের (প্রসীত গ্রুপ) সংগঠক অংগ্য মার্মা জানান, পাহাড়ে জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের নির্মূলে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রও কাজ করছে। আর এ প্রক্রিয়ায় শামিল হয়ে কিছু দলছুট ও নীতি বিচ্যুতরা একের পর এক হত্যাকা- চালাচ্ছে। তবে এ সংগঠক তাদের মধ্যে অঘোষিত সমঝোতার বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। পাহাড় নিয়ে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়, সবুজ পাহাড়ে অশান্তির বীজ যেন কিছুদিন পর পরই অঙ্কুরিত হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সিনেম্যাটিক কায়দায় হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে। চার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্যের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষও বলি হচ্ছে। বান্দরবানের ঘটনার পর পাল্টা একটি বড় ধরনের প্রতিশোধের ঘটনা খুবই আসন্ন বলে জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সরকারের সব সুবিধা ভোগ করে সন্তু লারমা ও তার উল্লেখযোগ্য কিছু নেতা একদিকে সরকারের বিরুদ্ধে, অপরদিকে ভ্রাতৃঘাতী সংগঠনে লিপ্ত থেকে পাহাড়ের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে রেখেছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগে প্রায় দুই দশকজুড়ে পাহাড়ে রক্ত ঝরানোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ সন্তু লারমা ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এমএন লারমা। তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল শান্তি বাহিনী। আর এ শান্তি বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ের সামগ্রিক পরিবেশকে রক্তাক্ত করে রেখেছে। সেটি ছিল ভিন্ন পরিবেশে। আর এখন যে রক্ত ঝরানোর কর্মকা- চলছে তা নিজেদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের।
×