ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে সনি, টয়োটা, তোশিবা, শার্প, প্যানাসনিক, এলজি কারখানা সরিয়ে নিতে প্রণোদনা, তহবিল গঠন করেছে জাপান কারখানা স্থানান্তরের তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া করোনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ পাওয়ার আশাবাদ অর্

বিনিয়োগে রুট বদল ॥ করোনা মহামারীর ধাক্কা

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১০ জুলাই ২০২০

বিনিয়োগে রুট বদল ॥ করোনা মহামারীর ধাক্কা

রহিম শেখ ॥ করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কায় এক দেশের বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে আরেক দেশে। চীন থেকে রীতিমতো রুট বদল করছে বিনিয়োগ। সরিয়ে নেয়া হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত নামী-দামী সব কারখানা। এ তালিকায় আছে জাপানের সনি কর্পোরেশন, টয়োটা বশোকু কর্পোরেশন, তোশিবা, ইলেকট্রনিক জায়ান্ট শার্প ও প্যানাসনিক, ঘড়ি উৎপাদনকারী সিকো ও ক্যাসিও। এজন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে জাপান সরকার। শুধু প্রণোদনা নয়, বিনিয়োগ স্থানান্তরে তহবিলও গঠন করেছে দেশটি। চীন থেকে কারখানা স্থানান্তর করতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ওষুধ কোম্পানি। উৎপাদন ব্যবসার ২০ শতাংশ সরিয়ে নেবে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এ্যাপল। তাইওয়ানের কম্পিউটার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কম্পাল ইলেক্ট্রনিক্স এবং দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি ইলেক্ট্রনিক্সও চীন থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। করোনাকালে এই বিনিয়োগ পেতে আবার আছে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগিতা। চীন ফেরত এসব বিনিয়োগ পেতে এগিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। তালিকায় আছে বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারসহ অনেক দেশের নাম। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী বদলে যাওয়া বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আসতে পারে বিপুল পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ। এদিকে দেশীয় উদ্যোক্তারা করোনা-পরবর্তী চীনসহ অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পেতে বিদ্যমান আইন-কানুন আরও সহজ, ব্যাংক খাতের সংস্কার, বিদেশী ঋণপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত, করনীতি সহজ, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শক্তিশালী, বিনিয়োগ আইন শক্তিশালী করাসহ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। গত এক দশকে ক্রমবর্ধমান মজুরি ও ব্যয়ের কারণে স্বল্পমূল্যের পণ্য উৎপাদকরা তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে না। বিশেষ করে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের প্রভাব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নোভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব। মহামারীটির কারণে অর্থনৈতিক ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণে। ফলে বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারকরা উৎপাদন খাতে স্বনির্ভরতা ও চীনের বিকল্প খুঁজে নেয়ার পক্ষে জোর দিচ্ছেন। ফিচ সলিউশনের এশিয়া কান্ট্রি রিস্কের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘অনেক দেশই চায়না প্লাস ওয়ান ম্যানুফ্যাকচারিং হাব কৌশল অবলম্বন শুরু করে দিয়েছে।’ কিছু দেশ এরই মধ্যে চীন নির্ভরতা কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাদের মধ্যে তাইওয়ান ও জাপান অন্যতম, যারা চীনের উৎপাদন খাতের উত্থান পর্বের শুরুতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী ছিল। তাইওয়ানের কর্মকর্তারা ২০১৯ সাল থেকে তাদের কোম্পানিগুলোকে চীনের বাইরে অন্য কোন সাপ্লাই চেন স্থাপনের জন্য উৎসাহ দিয়ে আসছে। গত বছর তারা একটি আইন পাস করে, যার অধীনে নিজ দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাইওয়ানিজ কোম্পানিগুলোকে ভাড়া সহায়তা, স্বল্প ব্যয়ে মূলধন সরবরাহ, কর অবকাশ ও নির্ঝঞ্ঝাট প্রশাসনিক সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। এতে কাজও হচ্ছে। গত বছর তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো নিজ দেশে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেছে অথবা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চলতি বছরের বাকি সময়ের জন্য দক্ষিণ কোরিয়াও একই ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজিয়েছে। গত মে মাসের শুরুতে সরকার জানিয়েছে, যেসব কোম্পানি নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কর প্রণোদনা, বিনিয়োগ-সম্পর্কিত নীতিমালা শিথিলীকরণ ও ব্যাপক আর্থিক সহায়তা। সাম্প্রতিক সময়ে জাপানও একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রশাসন সেসব কোম্পানির জন্য প্রায় ২২ হাজার কোটি ইয়েনের (২০০ কোটি ডলার) বাজেট বরাদ্দ রেখেছে, যারা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম নিজে দেশে ফিরিয়ে আনবে। এছাড়া সেসব কোম্পানির জন্য ২ হাজার ৩৫০ কোটি ইয়েন সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে জাপান সরকার, যারা তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা চীনের বাইরে অন্য কোন দেশে সরিয়ে নেবে। জাপানের বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরা হোল্ডিংসের এক জরিপ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে জানা যায়, চীনে নিবন্ধিত ৬৯০টি জাপানী কোম্পানির মধ্যে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ৭৯টি কোম্পানি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি ভিয়েতনামে, ১১টি তাইওয়ানে, ৮টি থাইল্যান্ডে, ৬টি মেক্সিকোতে ও ৩টি ভারতে গেছে। বাংলাদেশ পেয়েছে দুটি। করোনা-পরবর্তী সময়ে ১৬টি জাপানী কোম্পানির চীন ছাড়ার তথ্য পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত যেসব জাপানী কোম্পানি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে তাদের বড় অংশ যেতে চায় হ্যানয়ে (ভিয়েতনামের রাজধানী)। গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী মাজদা মোটর্স যেতে চায় মেক্সিকোতে। হোন্ডার সরবরাহকারী কাসাই কোগিও যেতে চায় উত্তর আমেরিকা অথবা ইউরোপে। প্রিন্টার ও ফটোকপিয়ার যন্ত্র উৎপাদনকারী রিকো কর্পোরেশন যেতে চায় থাইল্যান্ডে। শার্প যেতে চায় ভিয়েতনাম অথবা তাইওয়ানে। সিকো ও ক্যাসিও থাইল্যান্ডে যেতে চায়, অথবা জাপানেই ফিরতে চায়। টয়োটা তাদের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা জাপান অথবা থাইল্যান্ডে নিতে আগ্রহী। এছাড়া জাপানের মিৎসুবিসি ইলেক্ট্রনিক, তোশিবা মেশিন কোম্পানি ও কোমাৎসু, তাইওয়ানের কম্পিউটার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কম্পাল ইলেক্ট্রনিকস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি, এসকে হাইনিক্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কারখানা ইতোমধ্যে সরিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানিগুলো চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে মরিয়া। চীনে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ উৎপাদকদের বেশির ভাগ ইন্দোনেশিয়ায় কারখানা সরিয়ে নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া চীন থেকে উৎপাদন ব্যবসার ২০ শতাংশ ভারতে সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এ্যাপল। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম জানান, কারখানা স্থানান্তরের সুফল বাংলাদেশ পাবে। এ লক্ষ্যে গত ১২ মে এফবিসিসিআই জাপানী বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা বলেছি, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী। এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে আনুক। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা দিতে তারা আগ্রহী। এফবিসিসিআই একই ধরনের চিঠি দিয়েছে আঞ্চলিক বাণিজ্য সংগঠন কনফেডারেশন অব এশিয়া-প্যাসিফিক চেম্বারস অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিকে (সিএসিসিআই)। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি জানান, ‘চীন থেকে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আসছে। চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি সরাসরি চীনা বিনিয়োগ পেতেও সরকার কাজ করছে। সে বিনিয়োগ আসছে।’ ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, কোভিড-১৯-পরবর্তী চীন সে দেশের বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা কমাতে চাচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ চার-পাঁচটি দেশে বিনিয়োগ স্থানান্তরিত করতে আগ্রহী। বিশেষ করে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরবরাহ বা সাপ্লাই চেন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায় চীন। বাংলাদেশকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা সংস্কারসহ নীতি সহায়তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের বিনিয়োগ আইনটি এখনও দুর্বল। এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। বড় বিনিয়োগের আশা জাগাচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ॥ দেশে বড় বিনিয়োগ টানতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের মীরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীতে ৩০ হাজার একরের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত আছে। পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারী প্রায় ২৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসব ইজেডে বড় বিনিয়োগ আনার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী উন্নয়ন করে করোনা পরবর্তী বিনিয়োগ বাস্তবায়নে ৪ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা ঋণ সহয়তা দেবে বিশ্বব্যাংক। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে। শীঘ্রই এই অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি সই হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়া বেজার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চীন থেকে করোনা পরবর্তী সময়ে বহু কোম্পানি উৎপাদন কারখানা স্থানান্তর করবে। এ দেশের জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলে শুল্কমুক্ত আমদানি ও কর্পোরেট কর অবকাশ সুবিধা ২০২৩ সাল পর্যন্ত রয়েছে। সব বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগামী ১০ বছরের জন্য শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা বাড়ালে এ দেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। এ ছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় কারখানা স্থাপনের সময় থেকে সাত থেকে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করা হয়। জানা যায়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদেশী বিনিয়োগ আনার বিষয়ে আলাদা পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। এই চার সংস্থার পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। জাপানী বিনিয়োগে বেশি আশাবাদী বাংলাদেশ ॥ বাংলাদেশে এখন জাপানী কোম্পানির সংখ্যা ২৭০-এর মতো। বিগত কয়েক বছরে হোন্ডা মোটর কর্পোরেশন, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল, নিপ্পন স্টিল এ্যান্ড সুমিতমো মেটাল, মিতসুবিশি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ জাপানীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, এটি ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে। জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য আরও ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ দ্রুততর করা হচ্ছে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ২ হাজার একর জমি তৈরি রাখা হচ্ছে। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী মনে করেন, করোনা-পরবর্তী বিদেশী বিনিয়োগ ও স্থানান্তরিত কারখানাকে বাংলাদেশে আনতে তারা বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে বড় বিনিয়োগের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলা হয়েছে। এগুলো পর্যালোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) মহাসচিব তারেক রাফি ভূঁইয়া বলেন, সবার আগে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ দ্রুত শেষ করে জমি বরাদ্দ দেয়া উচিত। এছাড়া আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করা গেলে জাপানী বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, গ্লোবাল ইকোনমিতে একচেটিয়াভাবে কাজ করার কোন সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও অন্যান্য দেশের ন্যায় সুযোগ-সুবিধাও সৃষ্টি করতে হবে। সুবিধা দিতে আমরাও কিছু কাজ করছি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও কিছু কাজ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের সভাপতিত্বে বিডা, বেপজা, পিপিপি অফিসসহ আমরা পৃথক পৃথক বৈঠক করেছি। বিদেশীরা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসে কিছু সমস্যায় পড়েন, এসব সভায় আমরা বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রতিযোগী দেশসমূহ যেসব সুবিধা দিচ্ছে এগুলো তুলে ধরেছি, যেমন- ট্যাক্স হলিডে বাড়ানোর দরকার আছে। এছাড়া জমির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে, যেটা আগে ছিল না। এটা মওকুফের সুপারিশ করা হয়েছে।’ চীনা বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনতে বিশেষ সুবিধা ॥ বিদেশী বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিনিয়োগকারীরা যাতে তাদের অর্থ-লভ্যাংশ সহজে নিজ দেশে বা অন্যত্র নিয়ে যেতে পারেন, সেজন্য ব্যাংকিং জটিলতা কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে গত ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর বরাবর চিঠি দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম-সচিব মু. শুকুর আলী। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে এখন থেকে বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা কোন বিদেশী বিনিয়োগকারী তার লভ্যাংশের অর্থ বিদেশী মুদ্রা (এফসি) এ্যাকাউন্ট খুলে সেই এ্যাকাউন্টে রাখতে পারবে। যখন খুশি তখন ওই এ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ নিজ দেশে বা অন্য দেশে নিয়ে যেতে পারবে। আবার ইচ্ছে করলে ওই অর্থ বাংলাদেশে নিজের প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পুনর্বিনিয়োগও করতে পারবে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্ট থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দেশে বিদেশী মুদ্রা লেনদেনকারী সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশী শেয়ারহোল্ডারের প্রদেয় লভ্যাংশ এখন থেকে এফসি হিসেব খুলে সেখানে জমা রাখা যাবে। তবে এই অর্থ যে লভ্যাংশ থেকে পাওয়া ব্যাংকগুলোকে তা নিশ্চিত হতে হবে। এফসি হিসেবে রাখা অর্থ পুনর্বিনিয়োগও করা যাবে। আবার চাইলে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া বা নগদায়ন করা যাবে। আগে বিদেশীদের লভ্যাংশের অর্থ দেশের বাইরে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তবে নতুন নিয়মে কেউ বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা নগদায়ন করলে সেক্ষেত্রে ১৪ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ এবং পরিসংখ্যান বিভাগকে জানাতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগ সহজলভ্য করতে আইন সংস্কারের উদ্যোগ ॥ সম্প্রতি প্রকাশিত আঙ্কটার্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৫৬ শতাংশ। জানা গেছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে চীন থেকে অনেক বিদেশী বিনিয়োগ অন্য দেশে স্থানান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের অনেক দেশ যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া তাদের নিজ দেশে বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন-কানুন, বিধিবিধান ও ব্যাংক প্রক্রিয়া সহজ করেছে। পরিবর্তন আনা হয়েছে নীতি কাঠামোতে। সূত্র বলেছে, চীনের অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশেও বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজনীয় আইন-কানুন সহজ ও যেখানে যেখানে প্রতিবন্ধকতা আছে, তা চিহ্নিত করে দূরীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৯৪৭-কে বাংলা ভাষায় রূপান্তর ও যুগোপযোগী করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। খসড়া আইনের ওপর সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত নেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আরও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত আইনে কী কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, সে বিষয়ে এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বেজা, বেপজা, বিডা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীসহ সকলের মতামত নিয়ে শীঘ্রই চূড়ান্ত করা হবে। এরপর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। ওখানে অনুমোদনের পর সংসদে উপস্থাপন করা হবে। তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে কোভিড-১৯ পরবর্তী এফডিআই প্রবাহের ক্ষেত্রে দেশে সম্ভাবনার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগানো যাবে।
×