ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক ডাঃ এমএ আজিজ

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:২৬, ১০ জুলাই ২০২০

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশ

মানবসভ্যতার জন্য কোভিড-১৯ এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা পরে ল্ডমেই সারাবিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। চলমান মহামারীতে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব উদ্ভূত সঙ্কট মোকাবেলায় কঠিন সময় পার করছে। তথাপি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসমূহ বিমান, স্থল ও নৌবন্দরসহ শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে লকডাউন কার্যকর করা হয়। কোভিড-১৯ ‘স্বল্প আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য, অন্ন ও অর্থনীতির মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনা, প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা, ১ কোটি রেশন কার্ডের বিপরীতে খাদ্য সহায়তা, প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগণকে ত্রাণ সহায়তাসহ ৩০০ কোটি টাকার কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীগণ সাধারণ মানুষের প্রতি খাদ্য সহায়তাসহ নানাবিধ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, যা দুর্যোগ মোকাবেলায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মহামারী চলাকালীন ত্রাণ বিতরণ ও লাশ দাফনসহ নানাবিধ কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের সল্ডিয় অংশগ্রহণের ফলে অনেক নেতা-কর্মী করোনায় আল্ডান্ত হয়ে প্রাণ হারান। তাদের সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কোন দেশই এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে এই মহামারী মোকাবেলা করতে পারবে না। সেটি মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী অর্থবহ কৌশল ও বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে এবং বৈশ্বিক দায়িত্ববোধের প্রেক্ষাপটে সার্ক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং বৈশ্বিক সম্মেলনে পাঁচ দফা প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ তহবিলে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার প্রদান করেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়াতেও তহবিল গঠনের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনা মহামারী চলাকালীন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ আঘাত হানে। প্রধানমন্ত্রীর সঠিক পরকিল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ ঘূর্ণিঝড় সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় এবং ৩ জুন ব্রিটিশ ডেইলি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এছাড়াও বিশ্বের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস কোভিড মোকাবেলায় জননেত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে। উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাও যখন মহামারী মোকাবেলায় বিপর্যস্ত, তখন আমরা আমাদের সীমিত সম্পদ ও অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়েও মহামারী মোকাবেলা করে যাচ্ছি। গত এক যুগে বর্তমান সরকারের আমলে স্বাস্থ্য খাতের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। যার ফলে দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। জনগণের স্বাস্থ্যসূচক বাড়তে থাকে এবং আন্তর্জাতিক নানা খেতাব অর্জিত হয়েছে। তবুও জনবহুল দেশ বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতে আরও মনোযোগ দেয়া এখন সময়ের দাবি। করোনা মহামারী ব্যবস্থাপনায়ও সরকার নানাবিধ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাসপাতালের অবকাঠামোগত দিক ও রোগীর সংখ্যাধিক্যের কথা চিন্তা করে সারাদেশে হাসপাতালসমূহকে কোভিড ও নন-কোভিড এ দুই ভাগে বিভক্ত করে রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও চিকিৎসা সুরক্ষা সরঞ্জাম বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সরবরাহ করা ও চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। একই সঙ্গে কোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘চিকিৎসা গাইডলাইন’ প্রস্তুত করা হয়। মহামারী মোকাবেলায় লোকবল সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। সময়ের সঙ্গে বেসরকারী হাসপাতালসমূহকে কোভিড চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১টি জঞ-চঈজ ল্যাব হতে পর্যায়ল্ডমে ৬৮টি ল্যাব স্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে ভেন্টিলেটর, হাই-ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা, অক্সিজেন, আইসিইউ বেডসহ আইসোলেশন সেন্টারসহ কোভিড চিকিৎসায় ডেডিকেটেড হাসপাতাল সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমনকি চিকিৎসার সকল খরচ সরকার বহন করছে। সরকারের যথাযথ গৃহীত পদক্ষেপের কারণেই আমাদের দেশে মৃত্যুহার অনেক কম। এমনকি বিগত প্রায় ১ মাস ধরে সংল্ডমণ ও মৃত্যু সংখ্যা একই মাত্রায় বজায় রয়েছে। কোন কোন জেলায় দৃশ্যমান উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। স্বাস্থ্য খাতকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সকল সময়েই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। মহামারী মোকাবেলায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকির মধ্যে রেখে নানা প্রতিকূলতার ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। দায়িত্ব পালনে করোনায় আল্ডান্ত হওয়ার ফলে ইতোমধ্যে ৭০-এর অধিক সহকর্মী চিকিৎসককে আমরা হারিয়েছি। এরই মধ্যে অনাকক্সিক্ষতভাবে আমাদেরই একজন সহকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যা খুবই মর্মান্তিক ও সকল চিকিৎসকের জন্য কষ্টদায়ক। প্রাণ হারানো সকল সহকর্মীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ও স্বজন হারানো পরিবারের জন্য রইল সমবেদনা। এরই মধ্যে মাস্ক ক্যালেঙ্কারি, স্বাস্থ্য অধিফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসকবান্ধব নয় এমন কিছু সিদ্ধান্তে যদিও সকল চিকিৎসকই মর্মাহত ও হতাশ, কিন্তু দেশের এই ল্ডান্তিলগ্নে চিকিৎসকগণ তাদের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ হতে বিন্দুমাত্র পিছু হটেননি। চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ইতোমধ্যে চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। দেশের জনগণও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবেলায় চিকিৎসকদের অবদানকে স্মরণ রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। করোনা মহামারী চলাকালীন সময়ে স্বাচিপ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে টেলিমেডিসিন ও কিছু জেলায় ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কার্যল্ডম পরিচালনা করে আসছে। সেইসঙ্গে সারাদেশে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকগণের সঙ্গে কেন্দ্রীয়/স্থানীয় স্বাচিপ নেতৃবৃন্দ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তবে আমাদের পুরোপুরি সফল হতে গেলে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে হবে এবং দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জন্য আশীর্বাদ। তার সঠিক নির্দেশনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় আমরা মহামারী মোকাবেলায় সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছি। এই বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের নেয়া উদ্যোগ তখনই সফল হবে, যখন জনগণ সল্ডিয়ভাবে সহযোগিতা করবে। জনগণকে সরকার নির্দেশিত সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তবেই সংল্ডমণের হার কমে আসবে। আমরা ফিরে পাব আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ধারা। লেখক : মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)
×