ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হিন্দী সিনেমায় নাচ এবং সরোজ খান

প্রকাশিত: ০১:২৬, ৯ জুলাই ২০২০

হিন্দী সিনেমায় নাচ এবং সরোজ খান

বলিউডের সিনেমার নাচ-গানের দৃশ্যÑ অতি আবশ্যকীয় ব্যাপার। চোখ ধাঁধানো জমকালো আয়োজনের নাচ-গান না থাকলে যেন পানসে মনে হয় সে ছবি। নির্মাতারাও তাদের ছবির আকর্ষণ বাড়াতে অসাধারণ কোরিওগ্রাফির ব্যবস্থা করেন। হিন্দী চলচ্চিত্রের অন্যতম একটি আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত নাচগানের দৃশ্যগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার ক্ষেত্রে যাকে পথিকৃৎ ভাবা হয় সেই কিংবদন্তি কোরিওগ্রাফার সরোজ খান না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এ বছর বলিউডে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। একে একে বিদায় নিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন অনেক চেনা জনপ্রিয় মুখ। তাদের দলে সর্বশেষ শামিল হলেন বিখ্যাত এই ড্যান্স কোরিওগ্রাফার। আশি ও নব্বই দশকে হিন্দী সিনেমায় তোলপাড় সৃষ্টিকারী জনপ্রিয় অধিকাংশ নাচ-গানের দৃশ্যগুলোর নেপথ্য কারিগর এই কৃতী নারী তার কাজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন বার বার। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। বলিউডের অনেক তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর সফল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো সরোজ খানের মৃত্যু তাদের সবাইকে ব্যথিত করেছে। ফেসবুক, টুইটারে তাদের অনেকেই নিজেদের একান্ত অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন বিভিন্ন ছবিতে কাজ করার সময় নাচ-গানের দৃশ্যগুলোকে অনবদ্য আকর্ষণীয় চোখ ধাঁধানো মনোগ্রাহী করে তুলতে তার অসামান্য অবদান এবং সহযোগিতার কথা। মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত বহু সাড়া জাগানো জনপ্রিয় ছবির কোরিওগ্রাফার ছিলেন সরোজ খান। মাধুরী তার মৃত্যুতে নিজের বেদনার্ত অনুভূতি প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন ‘আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে মাস্টারজি আর নেই। (উল্লেখ্য, মাধুরীসহ বলিউডের অনেক তারকাই সরোজ খানকে নাচের গুরু ভাবতেন। তাকে ভালবেসে সম্মান করে মাস্টারজি সম্বোধন করতেন)। তিনি ছিলেন আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার এবং গাইড। তার সঙ্গে ছিল আমার গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। শূটিংয়ের সময় সেটে তিনি আমার মায়ের ভূমিকা পালন করতেন। আমি তাকে মিস করছি ভীষণভাবে। তিনি পর্দায় একজন নারীকে অপরূপা, আবেদনময়, কাক্সিক্ষত এবং আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে জাদু জানতেন। তার মতো আমি আর কেউকে তেমনভাবে পাইনি। কোরিওগ্রাফার হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করতে। তিনি ছিলেন একজন গেম চেঞ্চারের মতো ব্যক্তি গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে। পুরুষ শাসিত বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একজন বিদ্রোহী নারী। অনেক চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দিতে হলেও বলিউডে তিনিই ছিলেন প্রথম নারী কুশলী, ক্যামেরার পেছনে থাকা অনন্য একজন গুণী মানুষ। বলিউড কিং শাহরুখ খানও সরোজ খানের মৃত্যুত শোকাহত হয়েছেন। তিনি সাম্প্রতিক প্রখ্যাত এই কোরিওগ্রাফারের অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম শিক্ষক। তিনি আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ফিল্মি নাচের ধরনগুলো দেখিয়ে দিতেন। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, নানাভাবে অনুপ্রেরণা, উৎসাহ দিতেন। সরোজজিকে আমি ভীষণ মিস করছি। সাবেক মিস ওয়ার্ল্ড বলিউড তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কিংবদন্তি এই কোরিওগ্রাফারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে বলেছেন, অগ্নিপথ ছবিতে তার সঙ্গে কাজ করার সময়কার অভিজ্ঞতাগুলো আমি ভুলতে পারব না। মাত্র তিন বছর বয়সে একজন শিশু শিল্পী হিসেবে হিন্দী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিনের পথপরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। তার আগে বলিউডে কোন নারী কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেননি। মাত্র নয় বছর বয়সেই কিশোরী সরোজ হিন্দী সিনেমায় সহকারী নৃত্য নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। বাবা ছিলেন করাচীর একজন উঠতি ব্যবসায়ী। পাক ভারত বিভক্তির পর তার বাবা-মা করাচী থেকে ভারতের মুম্বাই চলে এসেছিলেন ১৯৪৮-এ। মুম্বাইয়ের এক বস্তিতে তাদের ঠিকানা হয়েছিল। সেখানেই জন্ম সরোজের। শিশু বয়সেই নাচের প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক ছিল। তার ওপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টরিতে অকপটে সরোজ খান স্বীকার করে বলেন, আমি আমার নিজের ছায়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতাম ঘরে। বাবার অভাবের সংসার। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য তিনি আমাকে মুম্বাইয়ের ফিল্ম স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে শিশু শিল্পী হিসেবে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন প্রথম দিকে বিভিন্ন সিনেমায় কোরাস ড্যান্সার হিসেবে কাজ করেছি। আমি মধুবালার সঙ্গে ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবির নাচ-গানের দৃশ্যে নেচেছিলাম কিশোরী বয়সে। অনেক দুঃখ-দারিদ্র্য আর অভাবের নির্মম কষাঘাত সহ্য করতে হয়েছে তাকে ছোটবেলায়। বাবার অকাল মৃত্যুর পর অনেক ছেলেমেয়েকে বড় করে তুলতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন সরোজের মা। অনেক রাতে না খেয়েই ঘুমোতে হতো তাদের। তখন সিনেমায় একজন কোরাস ড্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন। এর মাধ্যমে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চলত তাদের। মাত্র তেরো বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তার চেয়ে ত্রিশ বছরের বড় একজন কোরিওগ্রাফারের সঙ্গে। যার অধীনে সরোজ তখন সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু খুব বেশি দিন সংসার করা হয়নি তার। এরপর আবার আরেকজনকে বিয়ে করে নতুন করে দাম্পত্য জীবন শুরু করেছিলেন সরোজ খান। একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে লড়ে গেছেন তিনি। তার জীবনের উত্থান, সাফল্য, দুঃখ-বেদনা, একজন গুরু হয়ে ওঠার নাটকীয় গল্প নিয়ে চমৎকার বায়োপিক হতে পারে বলিউডে। হিন্দী চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা বহু জনপ্রিয় নাচ-গানের দৃশ্যের নেপথ্য কারিগর হিসেবে সরোজ খানকে সবাই মনে রাখবে অনেকদিন।
×