ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

গানের ওপারে প্লেব্যাক সম্রাট

প্রকাশিত: ০১:২৫, ৯ জুলাই ২০২০

গানের ওপারে প্লেব্যাক সম্রাট

প্লেব্যাক স¤্রাট এন্ড্রু কিশোর। বেঁচে ছিলেন ৬৫ বছর। বলা যায় এর মধ্যে পুরোটা সময় কেটেছে তাঁর গান গেয়ে। গানের বাইরে এই মানুষটি আর কিছুই ভাবতেন না। একবার এক পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল, বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে আপনার ভাবনা কি? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। বৃহত্তর কোন বিষয় নিয়ে ভাবনা কিংবা আশা করার কাজ আমার নয়। তবে একজন শিল্পী হিসেবে কিছু ভাবনা তো অবশ্যই আছে। শুধু এই মুহূর্তে বলতে চাই, আমরা যেন আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলা সংস্কৃতিকে নিরাপদভাবে পৌঁছাতে পারি। কথাগুলো বলেছিলেন আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ বছর আগে। কারণ, বাংলা সংস্কৃতির দুর্দিন যে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে! তা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। বাংলা সিনেমার গানে এন্ড্রু কিশোর তার সময়ে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার সহজ-সরল গায়কী শ্রেতাদের যেমন মুগ্ধ করত, তেমনি তার সহশিল্পীদের। তার অনেক গানের সহশিল্পী কনক চাঁপা বলেছেন, এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে গান করা ছিল গর্বের বিষয়। যখন একসঙ্গে গান করতাম মনে হতো তার কণ্ঠ থেকে সোনা গলে পড়ছে। ঢাকাই সিনেমার স্বর্ণযুগ বলে যে সময়টাকে দর্শক দারুণভাবে উপভোগ করেছেন তার বিশাল কৃতিত্ব এই প্লেব্যাক স¤্রাটের। ভাবা যায় নাÑ একজন শিল্পী সিনেমার গান গেয়ে এত জনপ্রিয়তা কিভাবে অর্জন করলেন? এর উত্তর এই বাংলার সব জনপদের অসংখ্য মানুষ দিতে পারবেন! এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা গল্প বলা যাকÑ একবার এক বন্ধুর বিয়েতে রাজশাহীর প্রত্যন্ত এক এলাকায় যাচ্ছে এন্ড্রু কিশোর। সঙ্গে অন্য বন্ধুরাও। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বরযাত্রীর দল। এমন সময় সে দেখতে পায় Ñএকটা নেংটা ছেলে খেলছে আর এন্ড্রু কিশোরের গান গাইছে। এই ঘটনা তার শিল্পী জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি। সত্যিই এন্ড্রু কিশোর এর গানের শ্রোতার কোন বয়স নেই, শহর বা গ্রাম বলে কোন বিভেদ নেই। বাংলার সব জায়গাতে তিনি প্লেব্যাক স¤্রাট। তার গানে চরাচরÑ এই তেরশো নদীর ব-দ্বীপ। এই অকালে তাঁকে আমরা হারিয়ে ফেলবÑ এটা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি। গত বছর যখন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেলেন আমরা ভেবে নিয়েছিলাম কিশোর আবার ফিরবেÑ এই বাংলার মায়া ঝরা পথে। তার অসংখ্য শ্রোতার হৃদয়ে। শোনাবে তার জীবনের বাকি গল্প। কিন্তু তা যে আর হলো নাÑ এ জনমে। চলে গেলেন গানের ওপারে। তবে কি আমাদের জীবনের গল্প দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা এই অসময়ে রাত নেমে এলো? কেন-ই বা এই অবিরাম নক্ষত্র পতন? কি হবে আমাদের সিনেমের গানের, আমাদের শ্রোতাদের? কে পূরণ করবে এই শূন্যতা? তবে কি শেষ প্রদীপ ও নিভে গেল! এমন অনেক প্রশ্নই করা যায় ওই দূর আকাশে তাকিয়ে! এই অবেলায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু এসব এখন নিষ্ফল আবেদ। সান্ত¡না কেবল তার গান। তিনি এখন গানের ওপারে দাঁড়িয়ে। অন্তরীক্ষে, কোটি মানুষের অন্তঃস্তলে! এন্ড্রু কিশোরের গানের খ্যাতি দেশের বাইরেও রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুম্বাই পর্যন্ত তার পরিচিতি আছে। উপমহাদেরর প্রখ্যাত সঙ্গীতাজ্ঞ রাহুল দেব বর্মণ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মুম্বাই নিয়ে যান এবং তাকে দিয়ে হিন্দী গান করান। গান শেষে দেশে ফেরার সময় আর ডি বর্মণ তাকে সে দেশে থেকে যেতে বলেছিলেন, উন্নত শিল্প জীবনের আশায়। দেশপ্রেমিক কিশোর বিনয়ের সঙ্গে বুঝিয়ে বলেছিলেন, নিজের দেশেই তিনি থাকতে চান। শুনে রাহুল দেব বলেছিলেন, বাঘের বাচ্চা! সমসাময়িক সব শিল্পীই তার প্রশংসা করতেন। একবার এক সাক্ষাতকারে সুবীর নন্দী বলেছিলেন, এন্ড্রু কিশোরের গলাটা সিনেমেটিক। সিনেমার গান কিশোরের কণ্ঠে দারুণ মিলে যায়। এই কমপ্লিমেন্ট শুনে মনে হয়েছিল সুবীর নন্দী যথার্থ বলেছেন! সত্যিই এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠ ছাড়া যে ঢাকাই সিনেমার গানই মিথ্যা হয়ে যাবে! সেই আশির দশক থেকে যার গান শুনে অসংখ্য মানুষের ইচ্ছে হতো বসন্তের কোকিল হতে, দুরন্ত প্রেমিক হতে কিংবা ঘরছাড়া বিবাগি হতে। কখনও বা সুখের ভেলায় ভেসে যেতে। না, এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যু হতে পারে না! এত গান যার বেঁচে আছে। কম করে হলেও চল্লিশ বছরের সাধনা। যদিও সিনেমার গানে তার অভিষেক ঘটে সত্তর দশকে। কিন্তু আশির শুরুতে এন্ড্রু কিশোর হয়ে ওঠে বাংলার কিশোর কুমার। যার রোমান্টিক কণ্ঠের জাদুতে বুধ হয়ে আছেÑ বাংলার অজস্র শ্রোতা। আলুথালু চুল, মুখে কায়দা করে রাখা খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি, শ্যাম বর্ণের এই মানুষটি সময়ের সঙ্গে অসংখ্য শ্রোতাদের হৃদয়ের বেঁচে থাকবেন। কি সার্থক জীবন তার। কি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা তার! মৃত্যুর পর সারাদেশের মানুষ শোকে আজ বিহ্বল! কত স্মৃতি কত জনের হৃদয়ে ভেসে উঠছে। যেমন- এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে, কিশোর বেলার সেই স্মৃতি। নদী পাড়ের মানুষ আমরা। এপার থেকে ওপার খেয়া পার ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। হাতে রেডিও নিয়ে গান শোনার শ্রোতা তখন প্রায়ই দেখা যেত। হাটে-বাজারেও কোন বিষয় ছিল না। মানুষ হাঁটছে, বাজার করছে সঙ্গে রেডিওতে গান বাজছে। একবার খেয়াঘাটে বসে আছি, নদী পাড়ের অপেক্ষায়। যাত্রী তখনও আসেনি। কয়েকজন এসে নৌকা ছাড়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। মাঝি অপেক্ষায়। একজন যাত্রীর। যার হাতে রেডিও। এরই মধ্যে শুরু হয় নৌকার অন্য যাত্রীদের কলহ। অবশেষে রেডিও হাতে মানুষটি নৌকায় উঠলেন। একটা এনটেনা টেনে বেড় করলেন। ভলিউম বাড়ালেন। গান শুরু হলো। হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস... পিন পতন নীরবতা। জোয়ারে শান্ত নদীর মৃদু কম্পনের ঢেউ নৌকা ভর্তি সবাইকে ডুবিয়ে দিলেন এন্ড্রু কিশোর তাঁর সুরের দড়িয়াতে। এ তো সহজে শেষ হবে না তার এই ইন্দ্রজাল।
×