ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমফান তান্ডব ॥ বাঁধে আশ্রিত ২শ’ পরিবারে মানবিক বিপর্যয়

৪৫ দিন পরও সাতক্ষীরার ২১ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ২১:৩১, ৮ জুলাই ২০২০

৪৫ দিন পরও সাতক্ষীরার ২১ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে ॥ আমফান তান্ডবের দীর্ঘ ৪৫ দিন পরও আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী দিন কাটাচ্ছে। ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তা ও বেড়িবাঁধের ওপর কাদা পনির মধ্যে ওদের বাস। জোয়ারে ঘরের মধ্যে জমছে হাটু পানি। থাকার জায়গা নেই। সুপেয় পানি নেই। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। এমনকি মানুষ মারা গেলেও কবর দেয়ার জায়গাও নেই। আমফানে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধ এখনও মেরামত শুরু হয়নি। ফলে বিপর্যস্ত এই এলাকার শত শত পরিবারে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। বাঁধ ও রাস্তায় আশ্রিত প্রায় ২শ’ পরিবার মানবিক বিপর্যয়ে। এলাকাবাসীর দাবি , উপকূলীয় মানুষদের বাঁচাতে এলাকায় প্রয়োজন টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ। ইতোমধ্যে একই দাবিতে জেলা নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের আবুল কাশেম মোড়ল (৫৬) কপোতাক্ষ নদের পাড়ে মাটির ঘর বেঁধে বাস করতেন তিনি। ছেলে-মেয়ে নাতি-পোতা নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় তার বসতঘর। এরপর একে একে আঘাত হানে নার্গিস, ফণী, বুলবুল ও আমফানসহ ছোটবড় আটটি ঘূর্ণিঝড়। আইলার পর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ঘুরে দাঁড়ানোর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায় তারা। এরই মধ্যে আমফানের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গেছে। ঘর ভেসেছে। ঘরের চাল উড়ে গেছে। বালিশ, কাঁথা, মাদুর, চাল, ডাল যা ছিল ঘরে সবই ভেসে গেছে বানের পানিতে। একই কথা বলেন, শ্রীপুর কুড়ি কাউনিয়া ডুবে থাকা রাস্তা ও বাঁধের ওপর বসবাসরত আবুল হোসেন মোড়ল, ইমাম হোসেন ইদ্রিস ঢালী, নজরুল ইসলাম গাজী, আব্দুল জব্বার ঢালীসহ অনেকেই। আমফান তান্ডবের দীর্ঘ ৪৫ দিন পর বিধ্বস্ত এলাকায় যেয়ে দেখা যায় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পানিবন্দী মানুষের দিন কাটানোর দৃশ্য। এখানে কপোতাক্ষের বুকে বিলীন হয়েছে তাদের ২০টি পরিবারের ঘর। তারা এখন ঘরের মধ্যে পানির ওপর মাচান তৈরি করেছেন। এ মাচানের ওপরই তারা থাকেন। রান্না, খাওয়া, প্রসাব-পায়খানা সবই এ মাচানের ওপর। গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে প্রতাপনগর বাজার। এ বাজার থেকেই জীবন বাঁচাতে তরিতরকারি কিনে নিয়ে যেতে হয় নৌকায়। কেউ অসুস্থ হলে ডাঙ্গার ডাক্তারের কাছে নিতে হয় পানি ঠেলে। নারী-শিশু ও বয়স্কদের দুঃখের শেষ নেই। স্যানিটেশনের জন্য নারীদের অপেক্ষা করতে হয় কখন অন্ধকার নামবে। অজানা আতঙ্কে কাটে দিন। দিনের আলো যত কমে আসে মানুষগুলো ততই অসহায় হয়ে পড়ে এ পানিবন্দী গ্রামে। এ অবস্থা শুধু শ্রীপুর গ্রামের নয়, কুড়িকাউনিয়া, সনাতনকাটি, দৃষ্টিনন্দন, চান্দারআটি, বন্যাতলা, হরিষখালি, কোলা, কল্যাণপুরসহ গ্রামের পর গ্রামের দৃশ্য একই। পশ্চিমে খোলপেটুয়া ও পূর্বে কপোতাক্ষ নদের মাঝখানে এভাবে গ্রামগুলো গত ৪৫ দিন ধরে জোয়ারের পানিতে ডুবছে আর ভাসছে। প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, আমফানে বিধ্বস্ত কুড়িকাউনিয়া, হরিষখালি বেড়িবাঁধ এখনও নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হয়নি। ২১ গ্রামে এখনও জোয়ার ভাটা চলছে। চাকলা বাঁধটি সরকারের সহযোগিতায় এলাকাবাসী নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বাঁশ ও বস্তা দিয়েছে সরকার। শ্রম দিয়েছে এলাকাবাসী। এখানে প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা ক্লোজারের পাশ দিয়ে রিংবাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হলেও ঝুঁকি রয়ে গেছে। হরিষখালি বেড়িবাঁধের ভেঙ্গে যাওয়া ৩শ’ মিটার এলাকার কাজ করছে এলাকাবাসী। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২নং ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু সরকার মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, আমফানের তান্ডবে বিধ্বস্ত প্রতাপনগরের কুড়িকাউনিয়া বেড়িবাঁধ মেরামত করবে সেনাবাহিনী। অন্য স্থানের বাঁধে কাজ চলায় এই বাঁধ নিয়ন্ত্রণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। হরিষখালি বাঁধের ৬০ মিটার বাঁধের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চাকলা এলাকায় ভেঙ্গে যাওয়া সাইক্লোন সেন্টারের পাশে প্রায় ২শ’ মিটার ও অপর এলাকায় ৮০ মিটার বেড়িবাঁধের কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সরকারী চাল সাহায্য আর স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা । ২০০৯ সালের আইলার পর থেকে এই এলাকার বাঁধের মাটি তাদের স্বাভাবিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। লবণাক্ততায় মাটির গঠন পরিবর্তন হয়ে বন্ডিং ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে বেড়িবাঁধ টেকসই হয় না। আইলার পর থেকে প্রায় ২শ’ পরিবার উঁচু বাঁধের ওপর বসবাস করলেও তাদের সেই ঠিকানাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে আমফানে। বেড়িবাঁধ সীমানা করে মাছের ঘের করার কারণেও বাঁধ ও রাস্তা নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন এলাকাবাসী ও জেলা নাগরিক কমিটি।
×