তপন বিশ্বাস ॥ চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে সরকার। ব্যবসায়ীরা চাল সরবরাহ না করলে বিদেশ থেকে আমদানি করবে। মঙ্গলবার এর কার্যক্রম শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। দেশে বোরোর বাম্পার ফলন সত্ত্বেও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে তারা সরকারীভাবে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর দাবি তুলে সরকারী গুদামে চাল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চাল আমদানির হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
চলতি বোরো মৌসুমে সরকারীভাবে ৮ লাখ টন ধান এবং ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। কৃষকের কাছ থেকে বোরো ধান কেনা গত ২৬ এপ্রিল শুরু হয়েছে। ৭ মে থেকে শুরু হয় চাল সংগ্রহ। ধান-চাল সংগ্রহ শেষ হবে ৩১ আগস্ট। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনা হচ্ছে।
কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী চালকল মালিকরা (মিলার) সরকারকে চাল দিচ্ছে না। অনেক মিলার অবৈধ মজুদ গড়ে তুলে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চালকল মালিকরা সরকারীভাবে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর দাবি তুলেছে। তবে মিল মালিকদের দাবি নাকচ করে দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী মিল মালিকরা সরকারী গুদামে চাল সরবরাহ না করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। একইভাবে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল আমদানি করবে।
চাল আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে মোট ৫৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ। সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে বেসরকারীভাবেও চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে চাচ্ছে। সঙ্কট না থাকলেও কোন অবস্থায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় চাল আমদানির উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও চালের বাজার অস্থিতিশীল করা হলে এবং চালকল মালিকগণ সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী সরকারী খাদ্য গুদামে সঠিক সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করতে গড়িমসি করলে কৃষকের স্বার্থ ও চালের বাজার দর উভয়ের মধ্যে সমন্বয় করে প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে প্রয়োজনমতো চাল আমদানি করার কথা ভাবছে সরকার।
সরকার একের পর এক কঠোর বার্তা দিলেও তাতে পাত্তা দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। কোনভাবেই চাল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। একের পর এক চালের দাম বাড়িয়ে চলেছেন তারা। কোন কারণ না থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দাম বাড়ছে। সরকার যতই কঠোর হচ্ছে, ততই কৌশল বদলাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এবার সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে চালের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ত্রাণ বিতরণে সরকার মোটা চাল ব্যবহার করছে। এতে চাহিদা বেড়েছে। তাই এই চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে চালের দাম। দাম কমার নজিরও রয়েছে কোথাও কোথাও। রাজধানীর বাজারে কোথাও দাম বাড়ছে, আবার কোথাও কমছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরাও ভিন্ন মত পোষণ করছেন। এতে স্পষ্ট যে, চালের দাম বাড়ানো অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি মাত্র।
সম্প্রতি বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েই চলেছে। কয়েক দফায় দাম বেড়ে বর্তমানে ৩২ টাকার গুটি (মোটা) চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকা পর্যন্ত। বেড়েছে স্বর্ণা, পাইজামসহ অন্য মোটা চালের দামও। তবে বাজারে মোটা চালের খুচরা দাম বাড়লেও চিকন চালের দাম রয়েছে আগের মতোই।
চালের দাম নিয়ে খোদ ব্যবসায়ীদের মধ্যেই রয়েছে ভিন্নমত। বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারীভাবে মোটা চাল কেনায় কিছুটা সঙ্কট রয়েছে মোটা চালের। তবে এরপরও বাজারে পর্যাপ্ত চালের মজুদ আছে, তাই দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। তবে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে শুরু হওয়া বন্যা কত দিন থাকে বা এরপর কী হবে সেটা বলা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ছোট পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে মোটা চালের সঙ্কট চরমে, পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। তাছাড়া দামে কম হওয়ায় ত্রাণ বিতরণের সময় সবার চাহিদা থাকে মোটা চালের প্রতি। এজন্য চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বেড়েছে মোটা চালের।
রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁও ও কাওরান বাজারে প্রতি কেজি গুটি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকায়। তিন-চার দিন আগে বিক্রি হয়েছিল ৩৯ থেকে ৪০ টাকায়। আর দুই-তিন সপ্তাহ আগে এসব চাল বিক্রি হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে দাম বেড়ে প্রতি কেজি পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকায়, স্বর্ণা ৪২ থেকে ৪৪ টাকা কেজি দরে। দুই-তিন সপ্তাহ আগে এসব চাল বিক্রি হয়েছিল ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা কেজি দরে। দাম বেড়ে আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে, আতপ চাল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা, সরকারী মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা কেজি দরে।
তবে আগের দামে বিক্রি হচ্ছে চিকন চাল। এসব বাজারে খুচরা দামে প্রতি কেজি পোলাও চাল বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা, নাজির শাইল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা, মিনিকেট ৫৬ থেকে ৬০ টাকা।
বাজারের পাইকারি দোকানগুলোতে প্রতি ৫০ কেজির বস্তা আটাশ চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ টাকায়, পাইজাম ২২৫০, মোটা গুটি চাল ২০০০ টাকা, নাজির ২৫ কেজি বস্তা ১৪২০ থেকে ১৫০০ টাকা, বাঁশফুল ২৭০০ টাকা বস্তা।
কাওরানবাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী ও জব্বার স্টোরের মালিক জব্বার বলেন, মোটা চাল দিয়ে সাহায্য (ত্রাণ) দেয়ায় এখন বাজারের মোটা চালের সঙ্কট তৈরি হয়েছে, পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বেশি দাম রাখছেন পাইকাররা।
এ বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ও শাপলা রাইসের ম্যানেজার নোমান জানান, গত কিছুদিন ধরে মোটা চালের সঙ্কট রয়েছে। দামে কম হওয়ায় ত্রাণ বিতরণের জন্য মোটা চালের চাহিদা বেড়েছে। বাজারে চাহিদার তুলনায় মোটা চালের সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বেড়েছে, সরবরাহ বাড়লে দাম কমে আসবে। তবে চিকন সব চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে রাজধানীর বাবুবাজার, কদমতলী, কৃষি মার্কেটে মোটা কিংবা চিকন কোন চালের দাম বাড়েনি। এর পরিবর্তে গত দু’দিন ধরে কিছুটা দাম কমেছে সব ধরনের চালের। তবে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে শুরু হওয়া বন্যা কত দিন থাকে সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, চলমান বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে পরবর্তীতে দাম বাড়তে পারে চালের। এটা ক্ষতির ওপর নির্ভর করছে, কিন্তু এখনই বাড়বে না চালের বাজার।
এ বিষয়ে বাবুবাজার ও কদমতলী বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ নিজাম উদ্দিন বলেন, এখন কেন চালের দাম বাড়বে? এখন দাম বাড়ার পরিবেশ হয়নি বরং দাম কমেছে। গত কয়েকদিন ধরে সব ধরনের চালে এক টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে। মোটা চালের চাহিদা কম, তাছাড়া অন্য চালের ক্রেতাও খুব বেশি নেই। তাই দাম বাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তিনি বলেন, সরকারীভাবে এখন চাল সংগ্রহ হচ্ছে, তাই মোটা চালের সঙ্কট কিছুটা তৈরি হয়েছে। তবে বাজারে যে চাল মজুদ আছে সে তুলনায় ক্রেতা নেই। বাজারে ক্রেতা নেই তাহলে কেন দাম বাড়বে? যারা দাম বাড়াচ্ছেন তারা কেন চালের দাম বাড়াচ্ছেন জানি না।
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নিজাম উদ্দিন বলেন, চালের মজুদ দেখে বোঝা যায় আগামী এক মাসে দাম বাড়বে না চালের বাজারে। বাজারে যে চাল আছে ক্রেতা না থাকায় আরও দাম কমবে। আমাদের চিন্তার বিষয় এখন চলমান বন্যা নিয়ে। দেখতে হবে এটা কতদিন থাকে, কী পরিস্থিতি হয় ফসলের। যদি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় তবে বাজারের পরিবেশ আগামীতে কী হবে তা বলতে পারব না।