ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেরপুরে এক যুগ ধরে শিকলবন্দী এক নারী

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ৬ জুলাই ২০২০

শেরপুরে এক যুগ ধরে শিকলবন্দী এক নারী

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর ॥ আর্থিক দৈন্যদশার কারণে চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে শিকলবন্দি রয়েছেন শেরপুরের ঝিনাইগাতীর সীমান্ত পল্লীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিরপতি কোচ (৩৭) নামে এক নারী। উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের নওকুচি পাহাড়ী পল্লীর হতদরিদ্র পরিবারের ওই নারীর চিকিৎসা সহায়তায় কেউ এগিয়ে না আসায় এখন যেন সে খোদ পরিবারেরই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে হতাশা আর দুশ্চিন্তায় পরিবারটিও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবুও দুঃখ-কষ্ট আর গ্লানির মধ্য দিয়েই মানসিক ভারসাম্যহীন ওই সদস্যকে নিয়ে চলছে তাদের জীবনযাত্রা। জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের নওকুচি পাহাড়ী পল্লীর কোচ সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র সিধিরাম কোচ ও পাতিশ্বরী কোচের মেয়ে নিরপতি কোচের বিয়ে হয় স্থানীয় সতেন্দ্র কোচের সাথে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বসবাস করে কষ্টের সংসারে প্রায় ১৩ বছর আগে জন্ম নেয় একমাত্র সন্তান সঙ্গীত কোচ। কিন্তু সেই সন্তান জন্মের এক বছর পরই হঠাৎ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন নিরপতি কোচ। এরপর থেকেই সে প্রায়ই এদিকসেদিক ছুটে বেড়াতো, মাঝে-মধ্যেই যেতো হারিয়ে। ক্ষতিসাধন করতো আশেপাশের বাড়িঘরের। নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে গেলেই স্বামীসহ মা-বাবা ও ভাইদের হতে হতো নাজেহাল। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে স্থানীয়ভাবে তার চিকিৎসা করানো হলেও সম্ভব হয়নি উন্নত ও উপযুক্ত চিকিৎসা। ফলে নিরপতি কোচের অসুস্থতায় আসেনি কোন পরিবর্তন। বরং দিনদিন তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়ে যায় পরিবারের বিড়ম্বনা। এরই এক পর্যায়ে পরিবারটি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসকে আলিঙ্গন করে অগত্যা তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তার পায়ে পরায় শিকল। দিনের বেলায় বসতঘরের বাইরে কোন গাছের সাথে এবং রাতে ঘরে চৌকির পায়ায় শিকল বেধে রেখে রেখেই চলছে দীর্ঘ প্রায় একটি যুগ। একমাত্র সন্তান সঙ্গীত কোচ জামালপুর শহরের একটি দোকানে নামমাত্র বেতনে কর্মরত থাকলেও এখন ওই শিকলবন্দি নারীকে নিয়ে যেন বন্দি হয়ে পড়েছে বৃদ্ধ মা-বাবাসহ এক ঘরে বসবাস করা ৩ জনেরই জীবন। সজিব কোচ নামে নিরপতি কোচের এক ভাই থাকলেও বৈবাহিকসূত্রে সেও বসবাস করে পাশের এলাকায়। তারও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সম্ভব হয়ে ওঠে না মানসিক ভারসাম্যহীন বোন ও বৃদ্ধা মাতার খোঁজ নেওয়ার। তাই অসুস্থ মেয়ের মুখে একবেলা হলেও অন্ন তুলে দিতে অন্যের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে হয় পাতিশ্বরী কোচকে। নিরপতির ভাই সজিব কোচ জানান, নিরপতি কোচ অসুস্থ হওয়ার পর প্রথমে ঝিনাইগাতী ও শেরপুরে এবং পরবর্তীতে ময়মনসিংহে নিয়ে তাকে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু পরিবর্তন না হয়ে দিনদিন তার অবনতি হলে তাকে শিকল পরানো শুরু হয়। তবে মাঝেমধ্যে একটু পরিবর্তন হলে শিকল খুলে নিজেদের নজরেই তাকে রাখা হয়। আর্থিক অনটনের কারণে এখন আর তার কোন চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। নিরপতির মা পাতিশ্বরী কোচ বলেন, আর্থিক অনটনের কারণে একদিকে নিরপতির উপযুক্ত চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি, অন্যদিকে পরিবারের কোন আয় না থাকায় বাড়ি বাড়ি হাত পেতে অনেক কষ্টে চলছে তাদের জীবন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা সম্পদশালী ব্যক্তিদের তরফ থেকে তার চিকিৎসা সহায়তায় পাওয়া যায়নি কোন সাড়া। এছাড়া মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে তার নামে একটি ভাতা কার্ডের জন্য বহু নিবেদন করেও আজও সম্ভব হয়নি তা পাওয়া। এ ব্যাপারে স্থানীয় কাংশা ইউপি চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার কারণে ওই নারীকে শিকল বেধে রাখার ঘটনাটি তার জানা ছিলো না। তবে খোঁজ নিয়ে এখন নিশ্চিত হয়েছি। মূলতঃ ওই নারী দীর্ঘদিন যাবত মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও অবস্থাভেদে মাঝে-মধ্যে শিকলে বেধে রাখতে হয়। তার মতে, ছাড়া থাকলেই সে আশেপাশের বাড়িঘরে ক্ষতিসাধন করে। কয়েকদিন আগেও একটি মাইক্রোবাসে ঢিল ছুড়ে গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। আর এজন্যই বিড়ম্বনা এড়াতে তাকে শিকলে বেধে রাখা হয়। তবে ইউনিয়ন পরিষদের তরফ থেকে তার জন্য একটি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের ব্যবস্থাসহ চিকিৎসা সহায়তার জন্য বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরেও আনা হবে বলে তিনি জানান।
×